॥ ৩ ॥
বিপ্লবের ধাঁচে কোনও সার্বিক, আমূল পরিবর্তন না করেও যে গরিবের জীবনে পরিবর্তন আনা সম্ভব হচ্ছে, তা এই জন্যই যে সুচিন্তিত কোনও ষড়যন্ত্র দারিদ্রের মূল কারণ নয়। দারিদ্র তৈরি হয়, টিকে যায়, অগণিত ছোট ছোট ভুলভ্রান্তির জন্য। যেগুলো আসলে চিন্তার অভাবের জন্য রয়ে যাচ্ছে। অতিশয় সদিচ্ছা থেকে তৈরি প্রকল্প-পরিকল্পনাতেও তেমন ফাঁকফোকর থেকে যায় বলে দারিদ্র যতটা কমা উচিত ছিল ততটা কমে না। যেমন সংযোগের অভাবে উগান্ডার স্কুল ও ছাত্রদের বঞ্চনা। আবার জনগণের নিপীড়নে পিছপা নয় যে স্বৈরতান্ত্রিক শাসক, সে-ও এমন নীতি নিতে পারে যা বাস্তবিক দারিদ্র কমায়। যেমনটা ঘটেছে ইন্দোনেশিয়ায়।
তার মানে দাঁড়ায়, কোথাও নাছোড় দারিদ্র দেখলে প্রশ্ন করতে হবে, কেন দারিদ্র ঘুচছে না? কোথায় সমস্যা থেকে যাচ্ছে? সেগুলো চিহ্নিত করে তা ‘সারাই’ করাই হল আসল কাজ। কু-অভিসন্ধি, কিংবা মন্দ বিধিব্যবস্থার দিকে আঙুল তুলে ‘এমন তো হবেই’ বলে বসে থাকা অর্থহীন। কেমন নকশা তৈরি হলে গরিব তার প্রাপ্য পেতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
কোন প্রকল্প কাজ করবে, কোনটা করবে না, বুঝতে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি প্রয়োজন। এমন একটি পদ্ধতি ‘র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল’, সংক্ষেপে আরসিটি। এই পদ্ধতিটা শুরু হয়েছিল নতুন ওষুধের কার্যকারিতা বুঝতে। কিছু রোগীকে নতুন ওষুধটি দেওয়া হত। কিছু রোগীকে তা দেওয়া হত না। দু’দলকে নিয়মিত পরীক্ষা করে শেষে স্পষ্ট হত, ওষুধটা সত্যিই কাজ করেছে কিনা। উন্নয়নের প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তাই। ধরা যাক স্কুল-পড়ুয়াদের লিখতে-পড়তে পারার ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। শিক্ষকদের উপস্থিতি বাড়ালে কি তা সম্ভব? তা বুঝতে চেয়ে ‘র্যান্ডাম কন্ট্রোল’ পদ্ধতিতে একটি রাজ্যের কিছু বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকদের নিয়মিত উপস্থিত থাকার জন্য বাড়তি টাকা দেওয়া হল। কিছু বেসরকারি স্কুলে তা দেওয়া হল না। দু’বছর পরে দেখা গেল, বাড়তি টাকার জন্য শিক্ষকদের উপস্থিতি সত্যিই বেড়েছে। যে সব স্কুলে বাড়তি টাকা দেওয়া হয়নি, সেখানে তা বাড়েনি। যে সব স্কুলে শিক্ষকদের উপস্থিতি বেড়েছে, সেখানে ছাত্রদের নম্বরও বেড়েছে। তারা আগের চাইতে ভাল লিখতে পড়তে পারছে। রাজস্থানের এই পরীক্ষাটি থেকে বোঝা যাচ্ছে, শিক্ষকদের বেতনের একটি অংশ যদি তাঁদের উপস্থিতির সঙ্গে যুক্ত করা হয়, ‘উৎসাহভাতা’-র মতো, তবে তা পড়ুয়াদের লেখাপড়ার ক্ষমতা বাড়াতে পারে। আবার এই ধরনের ‘উৎসাহভাতা’ কখন বেশি ভাল কাজ করবে, তা বোঝার জন্যও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে একই পদ্ধতিতে। অন্ধ্রপ্রদেশে কিছু ক্ষেত্রে স্কুলের সব শিক্ষককে বাড়তি অনুদান দিয়ে, কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষককে ব্যক্তিগতভাবে বাড়তি অনুদান দিয়ে দেখা হয়েছে, কোথায় লেখাপড়ার উন্নতি হচ্ছে বেশি। দেখা গিয়েছে, ব্যক্তিগত অনুদানই বেশি ভাল ফল দিচ্ছে। এই বইয়ের একটি প্রবন্ধে এ বিষয়টি বিস্তারিত বলা হয়েছে।
আরসিটি পদ্ধতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিশ্রমসাধ্য, খরচসাধ্যও বটে। অনেকদিন ধরে, অনেক বিষয়ে নিয়মিত তথ্যসংগ্রহ করতে হয়। বারবার মূল্যায়ন করতে হয়। চার-পাঁচ বছরও লাগতে পারে। গোটা সময়টিতে খুঁটিনাটির প্রতি মনোযোগ দিতে হয় পূর্ণমাত্রায়। তত্ত্ব-নির্ভরতার চাইতে এই পদ্ধতি অনেক বেশি প্রত্যক্ষ-নির্ভর। আগাগোড়া বেশি জোর দিতে হয় তথ্য সংগ্রহ আর বিশ্লেষণে। গরিবের ন্যায্য প্রাপ্য আদায় করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্যে যে আবেগ কাজ করে, অনেক মানুষ একত্র হওয়ার যে উদ্দীপনা কিংবা দারিদ্র নিরসনের নতুন তত্ত্ব-মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার উত্তেজনা, কিছুই এর মধ্যে তেমন ভাবে নেই।
তা হলে হবে কী, নেহাৎ কেজো এই পদ্ধতি গরিবের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে দিব্যি কাজে দিচ্ছে। এই বইয়ে প্রবন্ধগুলিতে বেশ কিছু গবেষণার কথা বলা হয়েছে, যাতে গরিবের কীসে লাভ হচ্ছে, কীসে হচ্ছে না, তা এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে প্রতিষ্ঠা করা গিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সরকার সেই গবেষণালব্ধ ফলের ভিত্তিতে নীতি তৈরি করেছে। উদাহরণ—
নিয়মিত কৃমির ওষুধ খাওয়ালে স্কুলে আসার হার অনেকটা বাড়ে। এটা প্রতিষ্ঠা হওয়ায় ভারত-সহ তৃতীয় বিশ্বের নানা দেশে সরকার নিয়মিত স্কুলপড়ুয়াদের কৃমির ওষুধ খাওয়াচ্ছে।
বয়স অনুসারে পড়ুয়াদের বিভাজন না করে, লেখাপড়ার স্তর অনুসারে বিভাজন করে পড়ালে তারা বেশি দ্রুত শেখে। এটা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ভারতের একাধিক রাজ্যে রাজ্য সরকারের সহায়তায় এই পদ্ধতিতে পড়ানো হচ্ছে শিশুদের।
বিনা পয়সায় সরকার কিছু দিলে তার হেলাফেলা হবে, এমন আশঙ্কা থাকে। কিন্তু আফ্রিকার কিনিয়াতে দেখা গিয়েছে, ওষুধ লাগানো মশারির সামান্য দাম রাখলেও তার ব্যবহার কমে যায়। বিনা পয়সায় দিলে তা অব্যবহৃত পড়ে থাকে না, কাজেই লাগে। এই ফল মেলার পর আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ বিনা পয়সায় ওষুধ-দেওয়া মশারি বিতরণ শুরু করে।
গরিবের জন্য সরকারি প্রকল্পে চুরি আটকাতে ইন্দোনেশিয়ায় পরীক্ষামূলকভাবে তাদের এমন পরিচয়পত্র বিলি করা হয়েছিল, যাতে ছাপা ছিল গরিবের জন্য কী কী প্রকল্প রয়েছে, আর তা পাওয়ার শর্ত কী। এতে চুরি অনেক কমে যাওয়ায় গোটা দেশের জন্য এমন কার্ড তৈরি করে বিলি করেছে সরকার।