বরং হাতের কাছে যে সমস্যাগুলো রয়েছে, ছোটবড় বিচার না করে তার সমাধান খোঁজা চাই। কিংবা, সেই সব সমস্যার সমাধানে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো কেন কাজ করছে না তা বোঝা চাই। সেই চেষ্টা শুরু করলে দেখা যায়, বহু প্রকল্প যে সদিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যর্থ হয় তার কারণ তিনটি— আদর্শ, আন্দাজ আর আলস্য।
আমাদের দেশে ‘পলিসি’ বা নীতি বলতে লোকে যেটা বোঝে, প্রায়ই সেটা একটা আদর্শগত, তাত্ত্বিক ধারণা। কাজে প্রয়োগ করার মতো বস্তু নয়। যেমন ‘শিক্ষার প্রসার করতে হবে,’ এটাকেই অনেকে মনে করেন শিক্ষানীতি। কোনও এক মন্ত্রী এই ‘নীতি’ ঘোষণা করার পর কোনও এক আমলা তাঁর মর্জিমতো কোনও একটি পদ্ধতি ঠিক করেন। প্রায়ই সেটা তাঁর আদর্শগত বিশ্বাসের ভিত্তিতে। যেমন, গরিবের প্রকল্পে গরিবের যোগদান জরুরি। আমাদের দেশে সর্বশিক্ষা মিশনের অধীনে এমন কমিটি তৈরি হয়েছিল। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে অধিকাংশ অভিভাবক কমিটির কথা জানেনই না। যাঁরা কমিটির কথা জানেন, তাঁরাও জানেন না যে বাড়তি শিক্ষক নিয়োগ করা বা খারিজ করার অধিকার কমিটির আছে। আর জানলেই বা কী? একা একা গিয়ে চেঁচামেচি করলে লোক হাসানোই হয়। তাই যদি সবাই যোগ না দেয় তা হলে কেউই এগিয়ে আসবে না। ফলে গ্রাম শিক্ষা কমিটি প্রায় সর্বত্র অকেজো থেকে গেল, সর্বশিক্ষার উদ্দেশ্য সফল হল না।
দুঃখের বিষয়, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্তারা অনেকেই বোঝেন না যে নীতির উদ্দেশ্য ভাল হলেই তা ভাল নীতি হয় না। যখন বলা হয় যে নীতিটা কাজ করছে না, তখন তাঁরা যারপরনাই চটে যান। একে বলা চলে অজ্ঞতার ঔদ্ধত্য— “আমার তৈরি নীতি কাজ করছে কি না আমি জানি না?” আবার তথ্য-পরিসংখ্যান নিয়ে নীতির ব্যর্থতা প্রমাণ করে দিলে তাঁরা খুব পরিচিত কিছু কথা বলেন। যেমন, ‘সিস্টেম কাজ করে না,’ কিংবা ‘বড় বেশি দুর্নীতি।’ বা ‘দারিদ্র না কমলে কোনও কাজই হবে না।’ অনেকে আবার নানা দার্শনিক ব্যাখ্যা শোনান। যেমন ‘গাঁধীর আদর্শ না মানলে উন্নয়ন হবে না’, বা ‘যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণ চাই।’ এ কথাগুলো অন্তঃসারশূন্য। গাঁধীর পথে কী করে চলা যায়, কী করলে যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণ হবে, এগুলো স্পষ্ট না করে আদর্শের কথা বলা আষাঢ়ে গল্প ছাড়া কিছু নয়।
অর্থনীতিবিদরাও নানা ‘গ্র্যান্ড ফর্মুলা’ তৈরি করেন। যেমন, ‘বাজারের উপর সব ছেড়ে দেওয়া হোক,’ বা ‘বিকেন্দ্রীকরণ করা হোক।’ এর ফলে এমন একটা সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে, যেখানে প্রশ্ন করার অভ্যাসটাই তৈরি হচ্ছে না। গরিবের জন্য পুষ্টি বা শিক্ষার প্রকল্প আদৌ অপুষ্টি, অশিক্ষা কমাচ্ছে কিনা, সে প্রশ্ন যিনি তুলবেন, তাঁকেই বরং ‘গরিব-বিরোধী’, ‘সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক’ ‘কিংবা ‘সিআইএ-র চর’ বলে তকমা দেওয়া হয়। তার কারণ, ‘কী হচ্ছে,’ সেই প্রশ্নের চাইতে ‘কী হওয়া উচিত’, তার আলোচনাতেই আমরা আটকে রয়েছি। যে কোনও নীতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা দরকার, এটা যে কাজ করবে তা মনে করার কী কী কারণ আছে? অন্য ভাবে টাকাটা খরচ না করে এ ভাবে করব কেন? এই প্রশ্নগুলো করা হয় না বলে কোনও নীতি কাজ না দিলেও তাকে বাতিল করা আমাদের দেশে দুঃসাধ্য।
দ্বিতীয় সমস্যা, আন্দাজে নীতি বা প্রকল্প তৈরি করা। অপুষ্টি কমাতে চাল বিলি করার প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে বারবার। সস্তায় চাল পেলে অনেক সুবিধে হয়তো হয়, কিন্তু তাতে অপুষ্টি কি কমে? এত দিন চাল বিলি করার ফলে সত্যিই কি অপুষ্টি কমেছে? যেখানে অপুষ্টি কমেছে, সেখানে চাল বিলি করার জন্যই যে তা কমছে, তা কি নিশ্চিত? চাল বিলি না করে, কৃমি সংক্রমণ কমানো কি শিশুর অপুষ্টি কমাতে বেশি কাজ দিতে পারে? এমন কোনও প্রশ্নের উত্তর না জেনেই, স্রেফ আন্দাজে প্রকল্প তৈরি করা হয়। এর ফলে যদি বা চাল পৌঁছয়, অপুষ্টি কমে না। কারণ আরও কিছু চাল দেওয়া অপুষ্টি কমানোর উপায় নয়।
নীতি প্রয়োগের আগে প্রায়ই ‘পাইলট’ পরীক্ষা হয়। কিন্তু তা কেবল নিয়মরক্ষার জন্য। যে সতর্কতা, নিপুণতার সঙ্গে নীতির পরীক্ষা করা প্রয়োজন, তা হয় না। ধরা যাক আমরা দেখতে চাই, দুঃস্থ পরিবারকে বিনামূল্যে ছাগল-গোরু দিলে, পশুপালনের প্রশিক্ষণ দিলে তাদের আর্থিক উন্নতি হতে পারে কিনা। প্রকল্প শুরুর কিছু দিন পরে আর্থিক উন্নতি প্রমাণ পেলেই হবে না। একশো দিনের কাজ ভাল হওয়ার জন্য, কিংবা এলাকায় নতুন কারখানা খোলার জন্যও উন্নতি হয়ে থাকতে পারে। সেই সব সম্ভাবনাকে বাদ দিতে হবে। প্রকল্পই যে পরিবর্তন এনেছে, নীতি যে প্রত্যাশিত ফল দিচ্ছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত প্রমাণ পেতে হবে।
তৃতীয় সমস্যা আলস্য। স্কুল কমিটি যে কাজ করছে না, চাল বিলি করে যে অপুষ্টি কমছে না, সেদিকে কেউ কখনও মন দেয়নি। ‘চলছে চলবে’ করে চলে যাচ্ছে প্রকল্পগুলো। কোনও এক আমলা কোথাও বসে কেবল দেখে যাচ্ছেন, কমিটি তৈরি হয়েছে কিনা, চাল সরবরাহ হচ্ছে কিনা। এর কোনওটা আদৌ অভীষ্ট কাজটা (লেখাপড়ার মান বাড়ানো, অপুষ্টি কমানো) করছে কিনা, তা কেউ খেয়াল করছে না।
এই যে ‘চলছে চলবে’ করে চলা, সরকারি প্রকল্পে এটাই মস্ত বড় ঝুঁকি। কেউ ইচ্ছে করে প্রকল্পগুলো ব্যর্থ করে দিচ্ছে, এমনটা বেশির ভাগ সময়েই হচ্ছে না। এ ভাবেই আগে এমন কাজ করা হয়েছে, তাই এ ভাবে এখনও করা হচ্ছে। এমন শিথিলতাই গরিবকে তার বরাদ্দ সুযোগ-সুবিধে পেতে দিচ্ছে না।