টাকা পেলে গরিব অলস হয়ে যায় কিনা, তারও উত্তর মিলেছে। এক কথায় সে উত্তর— না। যারা প্রকল্পে টাকা পেয়েছে, আর যারা পায়নি, তাদের কাজের সময়ে (বাইরে ও ঘরে) হেরফের মেলেনি। বাংলাদেশে দেখা গিয়েছে, টাকা-ট্রেনিং পাওয়া মেয়েরা বরং আগের চাইতে অনেক বেশি সময় পরিশ্রম করছে। তবে মজুরি খাটার সময় কমিয়ে, প্রাণীপালনের মতো স্বরোজগারের কাজে বেশি সময় দিচ্ছে তারা। তাই বাইরে থেকে মনে হতে পারে, টাকা পেলে গরিব কাজে আসে না। আসলে হয়তো তারা আরও লাভজনক কাজ করছে।
তবে দুটো বিষয় খেয়াল করতে হবে। এক, এই সব প্রকল্পে গরিবকে যে টাকাটা গোড়ায় দেওয়া হচ্ছে, সেটা অনুদান। ফেরত দেওয়ার কোনও শর্ত সেখানে নেই। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ব্যাবসা করে গরিব দারিদ্র এড়াতে পারে কিনা, সে প্রশ্ন সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে বলা চলে যে, বাজারের নিয়মে এই ধরনের কাজ হবে না। সরকার বা অসরকারি সংস্থাকে দারিদ্র নিরসনের লক্ষ্যে গোড়ার পুঁজিটা দিতে হবে গরিবকে।
আর দুই, টাকার সঙ্গে সহায়তাও প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ, নিয়মিত কাজের খোঁজখবর, পরামর্শ, বেশ কয়েক মাস এটা চালাতে হবে।
কিন্তু যখন প্রশিক্ষণের প্রশ্ন নেই? যখন খাদ্যের জন্য, কিংবা সন্তানের পড়াশোনার জন্য স্রেফ টাকা দিচ্ছে সরকার? তখন কি মদ তামাকে নষ্ট হয় না টাকাগুলো?
উত্তর খুঁজতে বিশ্বব্যাঙ্কের গবেষক ডেভিড ইভান্স নানা দেশের ১৯টি এমন প্রকল্প দেখেছেন, যেখানে শর্তসাপেক্ষে (যেমন, সন্তানকে স্কুলে পড়ানোর জন্য), কিংবা শর্ত ছাড়াই, টাকা দেওয়া হচ্ছে গরিবকে। তিনি বলছেন, একজনও ওই টাকা মদ খেয়ে ওড়াচ্ছে না, তা বলা চলে না। কিন্তু তারা অতি সামান্য, হিসেবে আসে না। বাড়তি টাকা পাওয়ার পর মদ-তামাকের খরচ বাড়েনি, এমনই দাবি করছেন ইভান্স। “পেরুতে দেখা গিয়েছে বটে, হাতে টাকাটা এলেই লোকের রোস্টেড চিকেন, কিংবা চকোলেট কেনার একটা ঝোঁক থাকে। কিন্তু আশা করি পোড়-খাওয়া কর্তারাও সে জন্য গরিবকে দুষবেন না,” লিখছেন তিনি।
গত বছর দশ-বারো ধরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় স্পষ্ট হয়েছে, গরিবকে টাকা দেওয়া ‘বাজে খরচ’ নয়। বরং হাতে টাকা পেলে খাবারের জন্য সে বেশি খরচ করে। সন্তানের স্বাস্থ্য, শিক্ষার উন্নতি হয়। আর যদি এককালীন টাকার সঙ্গে প্রশিক্ষণও মেলে, তা হলে বাড়তি রোজগার করে আর্থ-সামাজিক অবস্থানে কয়েক ধাপ উঠে আসে সে। কয়েক বছরের মধ্যেই।
এমন ভাল খবরে মধ্যবিত্তের মন ভাল হবে কি? গরিবের রোজগার বাড়া মানে তার মজুরি, মাইনে বাড়া। সেই সঙ্গে তার সামাজিক উত্থানটাও অনেকে ভাল চোখে দেখেন না। সে দিনই এক ‘কাজের মাসি’ দুঃখ করছিলেন, তিনি ছুটি চাইলে বাড়ির মালকিন বলেছেন, “তা হলে তোমার মেয়েকে পাঠিয়ে দিও।” মেয়ে কলেজে পড়ে, বলতে মালকিনের প্রশ্ন, “তাতে কী হয়েছে?” গরিব যে বংশানুক্রমে খেতমজুরি, দিনমজুরি, ঝি-গিরি করবে, সেটাই ধরে নিয়েছেন পাকাবাড়ির কর্তা-গিন্নিরা। বর্ণব্যবস্থা আর দারিদ্র সেই ধারণাটা পোক্ত করেছে। এ বার হয়তো ধারণাটা নড়বড়ে হবে। গরিবের হাতে টাকা এলে সে অন্তত তার অনাদর করবে না।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ জুন ২০১৬