এত দেওয়া কি ভাল?
কেবল ঈর্ষার জ্বালা থেকে নয়, গরিবের ভাল চেয়েও প্রশ্নটা তোলা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানরা যেমন চিরকালই জোর গলায় বলে এসেছেন, গরিবকে দয়া করা মানে চিরকালের জন্য সরকার-নির্ভর করে তোলা। আর পাঁচজনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে রোজগারের তাগিদটাই তো হারিয়ে ফেলবে সে। অলস, অদক্ষ কিছু মানুষ তৈরি করাই কি সরকারের কাজ? আজ প্রায় সেই একই সুরে কথা বলেন এ দেশের মাঝারি চাষিরা। একশো দিনের কাজে গিয়ে দাঁড়ালেই টাকা মেলে যদি, ধান রোয়া, ধান কাটার কাজ করতে লোকে আসবে কেন? টাকা দিয়েও খেতমজুর মিলছে না।
তা ছাড়া, টাকাটা যে জন্য দেওয়া, সত্যিই কি সে কাজে লাগে? দু-টাকা কিলো চাল বাজারে ১৪ টাকায় বিক্রি হয়ে চোলাইয়ের ঠেকে খরচ হচ্ছে, এমন হরদম শোনা যায়। একশো দিনের মজুরির টাকার কতটা বিড়ি-মদে উড়ে যাচ্ছে, কে দেখছে? করদাতার টাকা গরিবকে দিয়ে ভোট-কুড়োনো নেতাদের লাভ হতে পারে, দেশের লাভ কী?
এমন উদ্বেগ কতটা ধোপে টেঁকে? তা বুঝতে অর্থনীতির বেশ কিছু গবেষক খতিয়ে দেখেছেন, যখন গরিবকে টাকা (বা অধিক রোজগারের উপায়) দেওয়া হচ্ছে, তখন তা আদৌ কাজে লাগছে, না কি নষ্ট হচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া থেকে পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে সাতটি প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য-পরিসংখ্যান কিন্তু বলছে, টাকাটা নষ্ট হচ্ছে না, কাজেই লাগছে। সেই লাভ কেবল তাৎক্ষণিক, এমনও নয়। পাঁচ-সাত বছর পরেও দেখা যাচ্ছে, টাকা পাওয়ার পর যারা রোজগার বাড়িয়েছিল, তারা তা ধরে রাখতে পেরেছে। ফের গরিব হয়ে যায়নি।
উদাহরণ আছে এ রাজ্যেই। ওই ছ’টি প্রকল্পের একটি হয় মুর্শিদাবাদে। অতি গরিব ৩০০টি পরিবারকে বেছে নিয়ে, তাদের রোজগার বাড়াতে ছাগল, শুয়োর, গোরু বিলি করা হয়েছিল বছর আট-দশ আগে। অন্য ভাবে রোজগার বাড়াতে চাইলে তার উপকরণও (যেমন ধান ভানার ঢেঁকি) দেওয়া হয়েছিল। এই পরিবারগুলিকে এক বছর ধরে দৈনিক ২১ টাকা করে দেওয়া হয়, যাতে অভাবের তাড়নায় তারা ছাগল-গোরু বিক্রি করে না ফেলে। সেই সঙ্গে প্রাণীপালন, টাকা-পয়সা জমা-খরচের ট্রেনিং, সাহস-সহায়তা জোগাতে প্রতি ৫০ পরিবার পিছু একজন প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হয়। ‘বন্ধন’ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার (এখন ব্যাঙ্ক) এই প্রকল্পের শেষে দেখা গেল, ৯৪ শতাংশ পরিবারই বাড়তি আয় করছেন। নিয়মিত ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে তা শোধ করে ফের ঋণ নেওয়ার চক্রে চলে এসেছেন। সাত বছর পরে মূল্যায়ন করে দেখা গিয়েছে, কেউ আগের অতি-দারিদ্রে ফিরে যাননি। এককালীন সম্পদ ও প্রশিক্ষণ দীর্ঘমেয়াদী ফল দিচ্ছে।
উত্তর উগান্ডায় প্রায় এমন ভাবেই অতি-দরিদ্র মেয়েদের হাতে দেওয়া হয়েছিল দেড়শো ডলার, ব্যবসার প্রশিক্ষণ। ব্যবসা শুরুর পর কিছুদিন দেখভালও করেন প্রশিক্ষক। তার ১৬ মাস পরে দেখা গেল, এই মেয়েদের রোজগার প্রায় ডবল হয়েছে, ব্যবসাও বেড়েছে দ্বিগুণ। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, ঘানা, হন্ডুরাস, পেরুতে অতি-দরিদ্রদের অনুদান ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার সাতটি প্রকল্প থেকে দেখা যাচ্ছে, বছরখানেক পর থেকেই রোজগার বাড়ছে, তিন-চার বছর পরেও সেই উন্নতি বজায় থাকছে। যার একটা লক্ষণ, আগের চাইতে ভাল খাওয়াদাওয়া করছে পরিবারগুলি। যাঁরা দিনে দু’বার খেতেন, দেখা যাচ্ছে তাঁরা আরও একবার খাচ্ছেন। কোথাও বা গবেষকরা মেপে দেখেছেন, আগের চাইতে দিনে ৭০০ ক্যালোরি বেশি খাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। খাবারের জন্য খরচ হচ্ছে বেশি।
অনুদান দিয়ে দারিদ্র কমানোর এই যে মডেল, তার পথিকৃৎ কিন্তু বাংলাদেশ। সে দেশের একটি অসরকারি সংস্থা (BRAC) গ্রামীণ বাংলাদেশের ৪০টি এলাকায় অতি-দরিদ্র, অক্ষরপরিচয়হীন মেয়েদের তাদের পছন্দের কাজের জন্য (ছাগল-মুরগি পালন, ছোটখাটো মুদির দোকান) এককালীন টাকা দেয়, সেই সঙ্গে প্রায় দু’বছরের প্রশিক্ষণ আর নজরদারি চলে। ২০০৭ সালে শুরু এই প্রকল্পের বেশ কয়েকবার মূল্যায়ন হয়েছে। তাতে কেবল যে বাড়তি রোজগার (৩৮ শতাংশ) ধরা পড়েছে তাই নয়। দেখা যাচ্ছে, এই মেয়েদের জীবনযাত্রাও বদলেছে। এলাকার মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির কাছাকাছি তাদের জীবনশৈলী।
যে গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের এই প্রকল্পটির উপর নজর রাখছেন, তাঁরা লিখছেন, “এই গবেষণায় স্পষ্ট প্রমাণ মিলছে যে অতি-দরিদ্রদের যে রোজগারের জন্য বা অন্যান্য কারণে, অ-গরিবদের উপর নির্ভর করতেই হবে এমন নয়। গ্রামীণ সমাজে গরিবদের অবস্থান যে নির্দিষ্ট, অপরিবর্তনীয়, এমনও নয়। যদি তাঁদের জন্য যথেষ্ট পুঁজি এবং দক্ষতার ব্যবস্থা করা যায়, তা হলে অন্যান্য বাধা (সামাজিক বিধিনিষেধ, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণের অভাব, ক্ষতিকর অভ্যাস, বিনিয়োগ-লাভ বিষয়ে ভুল বা অস্পষ্ট ধারণা) এত বড় হয়ে দাঁড়ায় না, যে তা অতি-বঞ্চিত মেয়েদের স্বাধীন, সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠা আটকাতে পারে।” এ কথাটা যে সব দেশে, সব সংস্কৃতিতে সত্য, গত বছর দশেকে তার যথেষ্ট প্রমাণ মিলেছে।
আরও কয়েকটা চালু ধারণায় ধাক্কা দিয়েছে এই প্রকল্পগুলি। সাধারণত মনে করা হয়, এক সঙ্গে বেশি টাকা দিলে গরিব সামলাতে পারবে না। কিছু কিছু করে দেওয়াই ভাল। নানা প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য খতিয়ে দেখে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, মাসে মাসে কিছু টাকা দিলেও রোজগার বাড়ে, কিন্তু তুলনায় সামান্য। এক সঙ্গে বেশি টাকা দিলে রোজগার বরং এক লাফে অনেকটা বাড়ছে।