তবে সরাসরি অ্যাকাউন্টে টাকা আসার বিষয়ে যে সব আশঙ্কা রয়েছে, তা-ও যে অনেকটা অমূলক তা দেখাচ্ছে আর একটি সমীক্ষা। অন্ধ্রপ্রদেশে একটি সমীক্ষায় অর্থনীতিবিদ কার্তিক মুরলীধরন ও তাঁর সহকর্মীরা দুটি প্রকল্পের টাকা স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করেন, একশো দিনের কাজের প্রকল্পের মজুরি, এবং সামাজিক সহায়তা প্রকল্পের ভাতা। এই প্রকল্পে অবশ্য স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে টাকা দেওয়ার সরকারি ব্যবস্থায় দুটি পরিবর্তন আনা হয়। এক, স্মার্টকার্ডে প্রাপকদের ‘বায়োমেট্রিক’ তথ্য (মুখের ছবি ও আঙুলের ছাপ) রাখা হয়। আর দুই, ডাকঘর থেকে টাকা সংগ্রহ করার রীতি বদলে, প্রতি এলাকায় স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে টাকা বণ্টন করা হয়। তাঁর কাছে একটি ছোট যন্ত্র থাকে, যা দিয়ে তিনি স্মার্টকার্ডের আঙুলের ছাপ মিলিয়ে নিয়ে টাকা দেন। রশিদ ছেপে বার করে দেয় ওই যন্ত্রই। ওই সমীক্ষা প্রকল্পে দেখা গিয়েছে, স্মার্টকার্ডের ব্যবহারে আরও দ্রুত টাকা পৌঁছনো যাচ্ছে উপভোক্তাদের কাছে, টাকা হাপিশ হচ্ছে কম, উপভোক্তাদের সন্তুষ্টিও বেশি। প্রকল্পটি যে সব এলাকায় করা হয়, সেখানকার প্রায় ৭০ শতাংশ উপভোক্তা একশো দিনের কাজের প্রকল্পের মজুরি স্মার্টকার্ডে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের ৭৮ শতাংশ উপভোক্তা স্মার্টকার্ড বেছে নেন। যাঁরা মনে করছেন, রেশনে চাল-গম দেওয়াই ভাল, নগদ দেওয়া ভাল নয়, তাঁরাও কেন চিন্তা করবেন না, কী ভাবে আধার কার্ডের মাধ্যমে শস্য বণ্টন প্রক্রিয়া আরও উন্নত, দক্ষ করা যায়?
তবে আধার কার্ডের বিরোধিতার আরও গভীর একটা কারণ রয়েছে। তা হল, ‘নাগরিক সমাজ’ বলতে যা আমরা বুঝি তার একটা বড় অংশ মনে করে, রাষ্ট্র অত্যন্ত দরিদ্র-বিদ্বেষী। তাই রাষ্ট্র আগ্রহ নিয়ে কোনও কিছু করতে চাওয়া মানে, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’। এক একদিন সকালে কাগজ খুললে খানিকটা আন্দাজ করা যায়, কেন তাঁরা এমন মনে করছেন। তবে শেষ অবধি কথাটা বিশ্বাস করা চলে না। ভারতে রাষ্ট্রের উপর বরাবরই নানা দিক থেকে নানা পক্ষ প্রভাব কায়েম করতে চেয়েছে। সেই প্রতিযোগিতা হয়তো আগের চাইতে এখন আরও বেশিই তীব্র। গরিবের কাছে রাষ্ট্রের সম্পদ পৌঁছে দেওয়ার যে ব্যবস্থা এখন চলছে, তা যে অতীতেও কল্যাণকামী এক রাষ্ট্র বরাবর গরিবের জন্য চালিয়ে এসেছে, তা তো নয়। ইন্দিরা গাঁধী ‘গরিবি হঠাও’ ডাক দিয়েছিলেন, আবার তুর্কম্যান দরজাও বানিয়েছিলেন। রাষ্ট্র যে গরিবকে সম্পদ দিচ্ছে, তা বহু লড়াইয়ের ফল, যা গরিব মানুষ ও তাঁদের সমর্থকেরা লড়েছেন। আর সেই সঙ্গে ভোটে জেতার দায় থেকে মাঝেমাঝে খয়রাতি। রাষ্ট্র বরাবরই কোনও-না-কোনও চাপের মুখে গরিবকে কিছু দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আধার কার্ডের চিন্তার মধ্যে এমন কী অন্তর্নিহিত সমস্যা আছে, যে তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিতর্ক, পরামর্শে যাওয়া চলে না? অন্য কোনও সরকারি উদ্যোগের মতো, আধার কার্ডের সুযোগকেও ভাল উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো চলে না?
আমাদের মতো যাঁরা আধার নিয়ে উৎসাহী, তাঁদের ক্ষেত্রেও সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনের প্রসঙ্গটি প্রযোজ্য। এটা হয়েই গিয়েছে বলে ধরে নেওয়া চলে না। ঠিক যেমন ধরে নেওয়া যায় না যে, সরকারি প্রকল্পে যা কিছু সমস্যা রয়েছে আধার সব ঠিক করে দেবে। আধার কার্যকর হলেও দেখতে হবে, কী করে বিপিএল তালিকায় অযোগ্য লোক ঢোকানো থেকে রাজনৈতিক নেতা আর তাঁদের বন্ধুদের আটকানো যায়। ওই কাজটাকে আরও কঠিন করার জন্য কী ভাবে নজরদারি আরও জোরদার করা যায়? আরও কেজো চিন্তা রয়েছে। তা হল, সরকারি প্রকল্পে প্রয়োগের আগে কি আধার কার্ডের ব্যবহারে কতটা কী সমস্যা হচ্ছে তা পরীক্ষামূলকভাবে দেখে নিলে ভাল হত না? মোবাইল ফোন, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধার কার্ডের সংযোগ কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা বোঝা গেলে ধারণা করা যেত, কী ভাবে একে কার্যকর করা যায়।
আর একটু দূর অবধি চিন্তা করলে আরও কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। আধার ব্যবস্থা যদি কার্যকর হয়, তা হলে একটা বোতাম টিপেই লক্ষ লক্ষ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো যাবে। ভোটের মরশুমে কিছু বাছাই নির্বাচন ক্ষেত্রের বাসিন্দাদের অ্যাকাউন্টে যদি আরও, আরও বেশি টাকা পাঠাতে থাকে ক্ষমতাসীন দল? টাকা দিয়ে ভোট কেনার জনমোহিনী রাজনীতিকে কী করে আটকানো যাবে? তা নিয়ে প্রশ্ন তোলারও এটাই সময়। নগদেই হোক আর জিনিসপত্রেই হোক, জাতীয় আয়ের কত অংশ মানুষের মধ্যে বণ্টন করা যাবে, সে-বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলকে একটা ঐক্যমত্যে আসতে হবে। সরকার যদি আরও বেশি নগদ সরাসরি মানুষকে দিতে চায়, তা হলে কোথাও একটা তাকে খরচ কমাতে হবে। হয়তো তখন সরকার বাধ্য হবে বিত্তবানের অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকি কাটছাঁট করতে।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ১ জানুয়ারি ২০১৩
গরিবের টাকা
একটা সময় ছিল, যখন গরিবকে অনেকে দেখত করুণার চোখে। আজকাল দেখে একটু বাঁকা নজরে। স্রেফ গরিব বলেই কি না পাচ্ছে লোকগুলো। জলের দরে চাল-গম পাচ্ছে, ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে মাঠে গেলেই ১৭০ টাকা মজুরি জমা পড়ছে ব্যাঙ্কে। হাসপাতালে বাচ্চা হলে হাতে কড়কড়ে টাকা, তারপর বাচ্চার অঙ্গনওয়াড়ির খিচুড়ি থেকে মিড-ডে মিলের ভাত-ডাল, ইস্কুলের জুতো-জামা-বই-সাইকেল, মেয়ে হলে ইস্কুল শেষে ২৫ হাজার টাকা, সরকার হাত উপুড় করেই রয়েছে।