যে দিক দিয়েই দেখা যাক, খাদ্যের নিরাপত্তা আইন ইউ পি এ সরকারের ঝুঁকি আরও বাড়িয়েই দিচ্ছে। গরিবের ঝুঁকিও কিছু কমাচ্ছে না। বেচারি গরিব। ‘নিরাপত্তা’-ও তার পক্ষে আর নিরাপদ নয়।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ জুলাই ২০১৩
আধার কী পারে
২০১১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার আধার কার্ড বিলি শুরু করে। ২০১৩ সালের পয়লা জানুয়ারি আধার কার্ডের নম্বর ব্যবহার করে ভর্তুকি, পেনশন, স্কলারশিপ প্রভৃতি সরকারি অনুদানের টাকা উপভোক্তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পৌঁছনোর কাজ শুরু হয়। বর্তমানে একশো কোটি মানুষের কার্ড রয়েছে বলে দাবি করেছে সরকার।
আজ থেকে কিছু কিছু এলাকায় আধার কার্ড দিয়ে সরকারি প্রকল্পের উপভোক্তাদের টাকা দেওয়া শুরু হবে, এই ঘোষণা শুনে রাজনৈতিক মহল বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বহু বছর পর সরকার এমন কোনও পদক্ষেপ করল, যা নিয়ে জমিয়ে তর্ক করা চলে। ব্যাপারটা ভাল না মন্দ, তা নিয়ে গলা ফাটানো যায়। অর্থনীতির লোকজন বলছেন, আধার খেলাটাই বদলে দিতে পারে। আর খাদ্যের অধিকার আন্দোলনের সমর্থকরা ফের জোট বাঁধছেন, ‘আধার কার্ড আর রেশনে খাবারের বদলে টাকা’ বিলির বিরুদ্ধে।
কিন্তু আধার নিয়ে যেটা একেবারে মূল প্রশ্ন, তা নিয়ে দু’পক্ষের কেউ কথা বলছে না। তা হল— ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার এই যে নতুন প্রযুক্তি হাতে এল, তা দিয়ে এবার পছন্দের প্রকল্পগুলোকে কী করে আরও কার্যকরী করা যায়? যাঁরা আধার-বিরোধী, তাঁদের অনেকের কাছে অবশ্য নতুন প্রযুক্তি জিনিসটাই সন্দেহজনক। তাঁরা মনে করেন, রেশন কার্ড চুরি যেতে পারে, ভিজে যেতে পারে, হারাতে পারে, ছিঁড়ে যেতে পারে, কিন্তু জিনিসটা অনেক দিনের পরিচিত তো বটে, তাই সেটাই ভাল। হতে পারে, রাম একটু চেষ্টা করলেই স্থানীয় পঞ্চায়েত বা পুরসভার সাহায্যে রঘুর নামে রেশন কার্ড করিয়ে নিতে পারে (সেই সঙ্গে তার নিজের নামেও একটা কার্ড থাকতে বাধা নেই)। সেই রঘু হয়তো মারা গিয়েছে, কিংবা জন্মই হয়নি তার। রেশন কার্ড থেকে পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দুঃসাধ্য।
আমার কাছে আধার কার্ডের এটাই মস্ত সুবিধে বলে মনে হয়। শেষ অবধি অন্তত আমার চোখের তারা, আর আঙুলের ছাপ, এ দুটোকে নিজের বলে দাবি করা যায়। আর কেউ নিজেকে আমি বলে দাবি করতে পারবে না, আমিও নিজের পরিচয় প্রমাণ করতে প্রায় সব সময়েই পারব। ফলে রাম রঘুর নামে কার্ড করে রঘুর বরাদ্দের কেরোসিন তুলতে পারবে না। রঘুর ফুটো ছাদ দিয়ে জল এসে কার্ড নষ্ট করে দিলেও রঘুর চাল-গম মার যাবে না। সেই সঙ্গে, যে হেতু সব ধরনের সরকারি অনুদান একটি কার্ডে গ্রথিত থাকবে, তাই আইন যদি নিষেধ করে, তা হলে রাম একই সঙ্গে ভর্তুকির কেরোসিন, আর ভর্তুকির গ্যাস সিলিন্ডার পেতে পারবে না।
ভারতে কোনও কিছুই একেবারে ঠিকঠাক, নিয়মমাফিক কাজ করে না। আধার কার্ডের ব্যবস্থাও করবে না। কারও কারও কাছে ঘুস চাওয়া হবে। তবে রেশন কার্ড যেমন নির্দিষ্ট ডিলারের সঙ্গেই যুক্ত, আধার কার্ড করানোর ক্ষেত্রে অন্য জায়গা থেকেও তা করানো চলে। সেটা কিছুটা সামাল দেবে ঘুসের দাপটকে। সরকারি নিয়ম, আধার কার্ড করতে চাইলে কারওকে ফেরানো চলবে না। তবু অনেককে হয়তো ফিরে যেতে হবে— কারও আঙুলের ছাপ উঠবে না, কারও ক্ষেত্রে কম্পিউটার আটকে যাবে, নেটওয়ার্ক কাজ করবে না। তবে আধার কার্ড তৈরি করতে কতটা হয়রানি হচ্ছে, তার তুলনা করতে হলে করা দরকার রেশন কার্ড বা পাসপোর্টের মতো অন্য সরকারি পরিচয়পত্র তৈরির অভিজ্ঞতার সঙ্গে। তাতেও ঝামেলা যে কিছু কম হয় না, সে তো জানা কথা।
আসলে আধারের প্রতি আপত্তির অনেকটাই কেবল এই কারণে নয় যে তা কাজ না-ও করতে পারে। রেশনে চাল-গম না দিয়ে, উপভোক্তার কাছে সরাসরি টাকা পৌঁছে দিতে পারে আধার কার্ড— সেই সম্ভাবনাতেই আপত্তি। বলা হচ্ছে, যে মানুষ নগদ টাকা চান না, তাঁরা কেরোসিন, খাদ্যশস্যই চান। জঁ দ্রেজ এবং রীতিকা খেরার একটি সমীক্ষায় এমন চাহিদাই নাকি ধরা পড়েছে। বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই ফলে সে ভাবে আস্থা রাখতে পারছি না। গবেষকদের প্রতি আমার অনাস্থা নেই, তাঁরা অত্যন্ত দক্ষ। কিন্তু এই ধরনের সমীক্ষায় কী উত্তর মিলবে, তা অবশ্যই নির্ভর করে কী ভাবে প্রশ্নগুলো তৈরি করা হচ্ছে, জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, তার উপর। আমি চাল-গম চাইব, না নগদ চাইব, তা নির্ভর করে আমার ধারণার উপর— কতবার রেশন ডিলার আমাকে বরাদ্দ না দিয়ে ফিরিয়ে দেবে, আমার প্রাপ্য টাকা আমার কাছে পৌঁছনোর আগেই গায়েব হবে কি না, চালের দাম বাড়লে সরকার টাকা বাড়াবে কি না, এমন অনেক বিষয়ে ধারণা, যার অনেকগুলো সম্পর্কেই কোনও স্পষ্ট তথ্য কারও কাছে নেই। ফলে আমার উত্তরটা নির্ভর করবে, যে ভাবে আমার কাছে নানা সম্ভাবনা তুলে ধরা হচ্ছে তার ভিত্তিতে আমার ধারণার উপর।
নগদ আর খাদ্যশস্যের মধ্যে বেছে নেওয়ার সুযোগ পেলে মানুষ বাস্তবিক কী করছেন, সেই সমীক্ষায় আমার ভরসা বেশি। গাঁধীবাদী শ্রমিক সংগঠন ‘সেল্ফ এমপ্লয়েড উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ (সেবা) দিল্লির কিছু বস্তিতে সমীক্ষা করে দেখেছে, শস্যের বদলে টাকা দিলে লোকেদের চাল-গম খাওয়ার পরিমাণে হেরফের হচ্ছে না, তবে হঠাৎ চিকিৎসার প্রয়োজন হলে সাহায্য হচ্ছে। মদ বেশি খাওয়া, বা অন্যান্য খারাপ আশঙ্কার কোনও সত্যতা মেলেনি। দেখা গিয়েছে, যে ১০০ জনকে খাদ্যের বদলে নগদ দেওয়া হচ্ছিল, ছ’মাস পরে ফের খাদ্যশস্য নেওয়ায় ফিরে আসার সুযোগ দিলে কেবল চার জন তাতে ফিরে গিয়েছে। এটা অবশ্য খুবই ছোট একটা সমীক্ষা, এবং অন্য নানা পরিস্থিতির রদবদল, যা সমীক্ষার ফলে প্রভাব ফেলে থাকতে পারে, সেগুলোকে এড়ানোর কোনও চেষ্টাও সে ভাবে করা হয়নি। আরও বিধিসম্মত, আরও ভাল সমীক্ষার ফলের জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।