ভারতে ছয় দশক ধরে সস্তায় চাল-গম দিয়ে অপুষ্টি মেটেনি। এখন বলা হচ্ছে, আরও সস্তায় আরও বেশি চাল-গম দিলে অপুষ্টি কমবে। গোড়ায় গলদ হচ্ছে কি না, মানে নীতিটাই ভুল কি না, তা কেউ ভাবতে রাজি নন।
যেমন ভাবতে রাজি নন পদ্ধতি নিয়ে। রেশন ব্যবস্থার মতো দুর্নীতি-জর্জরিত, অপচয়-বহুল ব্যবস্থা ভারতেও কম রয়েছে। কত চাল-গম নষ্ট হয় প্রতি বছর, তার আন্দাজ করতে গেলেও তাজ্জব হতে হয়। গোটা অস্ট্রেলিয়ায় যত গম উৎপন্ন হয়, ভারতের গুদামগুলোতে তা নাকি নষ্টই হয় প্রতি বছর। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত চার বছরে ভারতে ৭৯৪২ কোটি টন গম নষ্ট হয়েছে, যা উৎপাদনের ৯ শতাংশ। তার সঙ্গে রয়েছে চুরি। প্রতি বছর অর্ধেকেরও বেশি গম, আর প্রায় ৪০ শতাংশ চাল, গরিবের কাছে পৌঁছনোর আগেই গায়েব হয়ে যায়। ২০০৬-০৭ সালে কেবল পশ্চিমবঙ্গেই ১৯০০ কোটি টাকার চাল চুরি হয়েছিল, উত্তরপ্রদেশে ৩০০০ কোটি টাকারও বেশি। সরকারি হিসেবেই এই দশা। এখন আরও, আরও চাল-গম রেশন দোকানের মধ্যে দিয়ে বিতরণ হবে, শুনলে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই লাইন:
এ যেন দিবারাত্রে
জল ঢেলে ফুটোপাত্রে
বৃথা চেষ্টা তৃষ্ণা মিটাবারে।
কেন তা হলে রেশন ব্যবস্থা দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা?
বলা হচ্ছে, খাদ্য নিরাপত্তা এখন ‘অধিকার,’ তাই তা নিশ্চিত করতে সরকার দায়বদ্ধ। বাস্তব কিন্তু এই যে, রেশন দোকান পর্যন্ত খাদ্যশস্য পৌঁছে দেওয়াতেই সরকারের ‘খাদ্যের অধিকার’ বিষয়ে আইনি দায় শেষ হয়। ঠিক যেমন স্কুলের ক্লাসরুম-শৌচাগার তৈরি করে, শিক্ষক নিয়োগ করে, শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়ে ‘শিক্ষার অধিকার’ নিশ্চিত করার দায় শেষ হয়।
ছেলেমেয়েরা আদৌ অঙ্ক কষতে, বাক্য লিখতে শিখল কি না, তা জানবার কোনও পদ্ধতি সরকারের হাতে নেই। গরিব পরিবারগুলি পুষ্টিকর খাবার যথেষ্ট পরিমাণে খেল কি না, তা টের পাওয়ার কোনও উপায়ও নেই সরকারের হাতে। ‘আমি যখন দিচ্ছি, তখন ওরা নিশ্চয়ই পাচ্ছে,’ এমন একটা আলগা ধারণার ওপর ভিত্তি করে বছরের পর বছর প্রকল্পগুলো কাজ করে, যদিও সমস্ত তথ্য-পরিসংখ্যান, অভিযোগ-অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় সেই ধারণার বিপরীতে।
গরিবকে শিক্ষার অধিকার, খাদ্যের অধিকার দেওয়া হলে ঠিক কী দেওয়া হয়? যাঁরা অধিকার-আন্দোলনের শরিক, তাঁরা বলবেন, আইনি অধিকার পেলে আমজনতা আদালতে গিয়ে হকের পাওনা দাবি করতে পারেন। রাষ্ট্র সেই দাবিকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য। কথাটা ভুল নয়। কিন্তু কে আদালতে যায় মেয়ের স্কুলে শৌচাগার তালা-আঁটা রয়েছে বলে? কে পুলিশে নালিশ করে, রেশনে ৩৫০ গ্রাম চাল কম পেলে? কিংবা বেলা ১২টায় রেশন দোকান বন্ধ হয়ে গেলে? আর সত্যিই যদি হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তদের অধিকারভঙ্গের প্রতিটি অভিযোগ দায়ের হয় আদালতে, বিচারব্যবস্থা কি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে না?
অনেকে বলবেন, অধিকার-টধিকার কথার কথা, এ হল ভোটের রাজনীতি। খুব সস্তায় অনেক চাল দেব, এ কথাটা বললে গরিব মানুষ ভোট দেবে, আর কে না জানে ভারতে গরিবের ভোটই বেশি। এটুকু বেশ বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু বোঝা গেল না ইউ পি এ সরকার কী করে খাদ্য নিরাপত্তা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা আশা করছে। চাল-গমের বদলে গরিবের ভোট, এই হিসেব সে সব রাজ্যেই কাজ করবে যেখানে রেশনব্যবস্থা মোটামুটি ভাল কাজ করে। তার মধ্যে রয়েছে ছত্তিশগড়, তামিলনাড়ু, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ। এই রাজ্যগুলি দীর্ঘ দিন ‘দু’টাকায় চাল’-এর রাজনীতি করেছে, এদের রেশনব্যবস্থাও অন্যদের তুলনায় ভাল। কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশ ছাড়া অন্য রাজ্যগুলো চালাচ্ছে ইউ পি এ-র বিরোধী দলগুলো। তামিলনাড়ু বা ছত্তিশগড় যদি বা খাদ্যের বদলে ভোট ফর্মুলা কাজে লাগায়, তাতে ইউ পি এ-র সুবিধে কী? তামিলনাড়ুতে এক টাকায় ইডলি বিক্রির প্রকল্প চালু করে বিপুল জনপ্রিয়তা কুড়োচ্ছেন জয়ললিতা। ছত্তিশগড়ে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহকে লোকে বলে ‘চাওল বাবা।’
বরং ইউ পি এ-শাসিত রাজ্যগুলির সমস্যা তীব্র হতে পারে। বিপুল পরিমাণে চাল-গম কিনবে সরকার, সেই প্রত্যাশায় বাজারে শস্যের দাম বেড়ে যাবে। এদিকে সস্তার চাল-গম মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে লেগে যাবে বেশ কয়েক মাস। এর মাঝের সময়টা গাঁটের কড়ি খরচ হবে বেশি। সেই রাগ গিয়ে পড়তে পারে ইউ পি এ সরকারের উপরেই। তা আন্দাজ করেই হয়তো সনিয়া-রাহুলের আগ্রহ সত্ত্বেও কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীরা তাঁদের রাজ্যে তড়িঘড়ি খাদ্য নিরাপত্তার প্রকল্প শুরু করতে গররাজি।
অনেকে অবশ্য খাদ্যের অধিকারকে কেবল কার্যকারিতার প্রশ্নে বেঁধে রাখতে রাজি নন। তাঁরা বলছেন, রাষ্ট্র যে নাগরিকের কাছে নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ, সে-কথাটা আরও জোরালো করতেই শিক্ষার অধিকার, খাদ্যের অধিকার, কাজের অধিকার তৈরি করা দরকার। মুশকিল হল, এতে গরিবের চেয়ে নেতাদের সুবিধে বেশি। আইন পাশ করে ‘অধিকার’ তৈরি করেই নৈতিকতার পরীক্ষায় পাশ করে যান তাঁরা। কাজটা আর করে দেখাতে হয় না। খাদ্যের অধিকার আইন হওয়ার আগে যে রেশনে চাল পায়নি, আইন হওয়ার পরে সে কী করে চাল পাবে? শিক্ষার অধিকার আইন হওয়ার আগে যে স্কুলে গিয়েও নাম লিখতে শেখেনি, আইন হওয়ার পরে সে কী করে শিখবে? এমন প্রশ্নগুলো স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যাওয়া যায়। অধিকার-আন্দোলন দায়বদ্ধতা বাড়াতে গিয়ে আসলে দায় এড়ানোর পথ তৈরি করে দিচ্ছে।