ভারতে ডিফিড যে-প্রকল্পগুলোর জন্য টাকা দিয়েছে, তাতে বিদেশি অনুদান-প্রাপ্ত প্রকল্পের পরিচিত ঝুঁকিগুলো এড়িয়েছে। গরিবের সব সমস্যার জন্য একটাই সমাধান চাপানোর চেষ্টা করেনি ডিফিড। মূলত পুষ্টি, শৌচাগার আর মা-শিশুর স্বাস্থ্যের উপর জোর দিয়েছে। কাজ করেছে বিহার, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশে, যেখানে বেশি সংখ্যায় গরিব থাকে। আর যা সবচেয়ে জরুরি কথা তা হল, তারা ‘রেডিমেড’ সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেনি। তাদের কাজের মূল কথাই ছিল, ‘আমরা জানি না কেন এই সমস্যাগুলো হচ্ছে, এবং সেই কারণের অনুসন্ধান সমস্যার সমাধান বার করার একটি প্রধান উপায়।’
এই শেষের বিষয়টিই ভারতে বিদেশি অনুদানের প্রধান অবদান হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। ভারতের বিভিন্ন সরকারি দফতরে যে কর্মসংস্কৃতি, তাতে কী করলে কাজটা ঠিকমতো হবে, তার চাইতেও বড় হয়ে ওঠে, কী করা সুবিধে সেই প্রশ্নটা। কাজের যে পদ্ধতি-প্রক্রিয়া সম্পর্কে আগে থেকে একটু জানাশোনা আছে, সেটাই কাজে লাগানোর ঝোঁক দেখা যায়। এই মানসিকতা হল ঔপনিবেশিক প্রশাসনের অবদান। ভারতে সরকারি দফতরের কর্মীরা তাঁদের কাজের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন, অধিকাংশই এক বছর কি দু’বছর কাজ করে অন্য দফতরে চলে যাবেন। ফলে কঠিন সমস্যাগুলোর সমাধানে কী করা দরকার, তা বোঝার সময়, ইচ্ছে, ক্ষমতা, কোনওটাই তাঁদের নেই। যদি বা তাঁদের কারও ইচ্ছে থাকে কাজটা ঠিকমতো করার, রাজনীতির চরিত্র এমনই যে ক্ষমতাসীন নেতারা নতুন কিছু করে ভুল প্রতিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি নন। বৃহৎ প্রকল্প শুরু করার উচ্চাশায় লাগাম পরিয়ে, ছোট পরিসরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে রাজি নন।
এইখানেই অনুদানের ভূমিকা। যে হেতু ভারতে ক্ষমতা সামলানোর দায় নেই, তাই ডিফিড-এর মতো বিদেশি অনুদান সংস্থা কোনও একটি বা দুটি সমস্যাকে চিহ্নিত করে, ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রচেষ্টা-ভ্রান্তির মাধ্যমে সমাধানের দিকে এগোতে পারে। হাতে সময় নিয়ে পর্যালোচনা করতে পারে। সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে থেকে যে ধরনের সমাধান পাওয়া সম্ভব নয়, এমন দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার দ্বারা অনুদান সংস্থা সেই সমাধানের দিকে এগোতে পারে। এবং তাদের সেই কাজের সংস্কৃতি থেকে হয়তো এদেশে প্রশাসনের এমন একটা মডেল, একটা সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব, যা শেষ অবধি ভারতীয়দের নিজেদের সমস্যা সমাধানে সমর্থ করে তুলবে। ব্রিটিশ সরকার ভারতকে যে টাকা দিচ্ছে, শেষ বিচারে সেটা সব চাইতে জরুরি নয়। যা জরুরি, তা হল ব্রিটিশ সরকারের অনুদান সংস্থার ধৈর্য ধরার ক্ষমতা, স্বচ্ছতা ও গুরুত্বের সঙ্গে সমাধান খোঁজার ক্ষমতা। ফাঁপা জাতীয়তাবাদের কবলে পড়ে তা হারালে আফশোস করতে হবে।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১২
‘নিরাপত্তা’ কতটা নিরাপদ
খাদ্য নিরাপত্তা অর্ডিনান্স পাশ করল ইউ পি এ। সবাই বুঝল, দেশের সব নাগরিক যাতে যথেষ্ট খাবার পায়, তা নিশ্চিত করতে সরকার এখন আইনত বাধ্য। তবে তাতে হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তদের নতুন করে কী লাভ হল, তা ঠিক বোঝা গেল না।
ভারতে খাদ্যনীতি বলতে বোঝায়, গরিবের কাছে সস্তায় চাল-গম পৌঁছে দেওয়ার নীতি। সেই ষাটের দশক থেকে আজ পর্যন্ত আগাগোড়াই ধরে নেওয়া হয়েছে যে, রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে বাজার দরের চাইতে কম দামে খাদ্যশস্য বিতরণের ব্যবস্থা করলে তাতে দেশে অপুষ্টি কমবে। ভারতে অপুষ্টি তীব্র এবং ব্যাপক, তাই দেশ জুড়ে প্রায় ৫০ লক্ষ রেশন দোকান তৈরি করে তাতে বিপুল পরিমাণ চাল-গম সরবরাহ করতে হবে, এমন যুক্তির উপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে খাদ্যনীতি। আজ পর্যন্ত এই ধারণাকে কখনও কেউ প্রশ্ন করেনি।
অথচ সস্তায় চাল-গম দিলে অপুষ্টি কমে, সেই ধারণার সপক্ষে কোনও প্রমাণ মিলছে না। গরিব মানুষকে সস্তায় চাল-গম দিলে তাঁর যে-টাকা বাঁচে, ধরেই নেওয়া হয় তা দিয়ে তিনি বাড়তি খাদ্যশস্য কিংবা অন্য পুষ্টিকর খাবার কিনবেন। বাস্তবে গরিব মানুষ তাই করেন কি না, সেটা কখনও দেখা হয় না। ধরুন আপনি পরিবারের জন্য মাসে চল্লিশ কিলোগ্রাম গম কেনেন বাজারদরে, তাতে আপনাদের চাহিদা কোনও মতে মেটে। আপনাকে বিশ কিলোগ্রাম গম খুব কম দামে দেওয়া হল। আপনি নিশ্চয়ই খুশি হবেন, কারণ আপনার মনে হবে, হাতে কিছু টাকা রয়েছে। নিজেকে একটু কম গরিব মনে হবে। কিন্তু ওই বাড়তি টাকা দিয়ে কি বাড়তি কুড়ি কিলোগ্রাম গমই কিনবেন? নাকি ছেলেমেয়ের জন্য লজেন্স-চানাচুর কিনবেন, বাড়ির মেয়েদের জন্য শখের টুকিটাকি, বা আপনার মোবাইলের টকটাইম? রেশনে চালের দাম যদি দু’টাকাও হয়, বাজারে দাম ২২-২৬ টাকাই থাকবে। তাই শেষ চার-পাঁচ কিলোগ্রাম চাল কেউ বাজারদরে কিনবেন, নাকি ওই টাকাটা অন্য কাজে খরচ করবেন, সেই সিদ্ধান্ত তাঁকে নিতেই হবে।
দশ বছর অন্তর গোটা দেশে একটা সমীক্ষায় দেখা হয়, নানা রাজ্যের শহরে-গ্রামে পরিবারগুলি কীসে কত খরচ করে (জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার মাসিক ভোগব্যয় সমীক্ষা)। সেই সমীক্ষায় যে-ছবি উঠে আসে, তা থেকে স্পষ্ট হয় যে, কেবল অতি-দরিদ্র পরিবারগুলিই বেশি টাকা পেলে বেশি খাদ্যশস্য কিনছেন। তার চাইতে কিছু বেশি টাকা যাঁদের আছে, তাঁরা দারিদ্রসীমার নীচে থাকলেও হাতে টাকা থাকলে খরচ করছেন চিনি, মাছ-মাংস, তেল কিনতে। অতি-দরিদ্র পরিবার জনসংখ্যার কমবেশি ১০ শতাংশ। অপুষ্টি তার চেয়ে অনেক, অনেক ব্যাপক। অন্তত ৪২ শতাংশ শিশুর ওজন যে কম, সে-কথা তো ক’দিন আগে প্রধানমন্ত্রীই কবুল করেছেন। যার মানে, কেবল খাবার কেনার অক্ষমতা দিয়ে অপুষ্টির ব্যাখ্যা করা চলে না। একটা শিশুর পেট ভরাতে কতটাই বা চালডাল দরকার হয়? যে-বাড়িতে টিভি চলে, মোবাইল বসানো আছে চার্জে, সাইকেল ঠেস দেওয়া দাওয়ার গোড়ায়, চালডালের দামই কি তার সন্তানের অপুষ্টির কারণ? আফ্রিকার দক্ষিণের যে সব দেশে গড় আয় ভারতের চাইতে অনেক কম, সেখানেও শিশুদের পুষ্টি ভারতের শিশুদের পুষ্টির চেয়ে অনেক ভাল। কী করে হয়? তার একটা কারণ এই যে, ভারতে সামান্য টাকাতেও নানা লোভনীয় জিনিস কেনা যায়। পাঁচ টাকা-দশ টাকাতেই পাওয়া যায় প্লাস্টিকের চিরুনি, শ্যাম্পুর খুদে প্যাকেট, টিপের পাতা। ভারতের দেশ-জোড়া মস্ত বাজার রয়েছে, তাই অনেক কম-দামি জিনিস তৈরি হয়, বিক্রি হয়। আফ্রিকার গরিব দেশগুলিতে এ সব শখের জিনিস গরিবের নাগালের বাইরে। খাদ্যশস্য ছাড়া খুব কিছু গরিব মানুষ কিনতে পারেন না। তাঁদের ‘চয়েস’ কম, পুষ্টি বেশি।