অর্থাৎ সমস্যাটা ভর্তুকি নয়। সরকারি প্রকল্প কী ভাবে পরিকল্পিত হচ্ছে, কাজ করছে, প্রশ্নটা সেখানে। দুর্বল পরিকল্পনা, ভুল রূপায়ণ অকস্মাৎ হয় না। ‘গরিবের জন্য’ কোনও প্রকল্প তৈরি হলেই সেখানে এমন একটা আত্মম্ভরিতা থাকে, ‘যা হচ্ছে ঠিকই হচ্ছে’ এমন মানসিকতা কাজ করে, যে জরুরি প্রশ্নগুলো করা হয় না— এই প্রকল্প করার কি অর্থ হয়? এটা যে কাজ করবে, তার কি কোনও প্রমাণ মিলেছে? আর কোনও ভাবে কাজটা করলে কি এর উদ্দেশ্য আরও ভাল সাধিত হতে পারত?
জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্প এর একটা সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত। একবার যেই ঘোষণা করা হল যে ক্ষুধার্ত জনগণকে খাবার দেওয়া হবে, আর এই আইনের যাত্রা ঠেকানো গেল না। কেউ প্রশ্ন করল না, এ দেশে অপুষ্টি কি খাদ্যের অভাবের জন্য হচ্ছে, নাকি খাদ্যাভ্যাসে নানা ত্রুটির জন্য? সস্তায় চাল-গম দিলে যে অপুষ্টি কমবে, তার কি প্রমাণ আছে? ওই চাল-গমের টাকা যে আরও মোবাইল ফোন বা অন্যান্য শখের জিনিসে ব্যয় হবে না, তা বুঝব কী করে? কিন্তু বিরোধী বিজেপি অবধি এই প্রশ্নগুলো না তুলে সমর্থন করল আইনকে। অভিযোগ করলেন কেবল কিছু অর্থনীতিবিদ, যাঁরা সব বিষয়েই আপত্তি তোলেন।
হাতের কাছে যা সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে, তার সবই এটাই ইঙ্গিত করে যে, খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্পে অপুষ্টির সমস্যা প্রায় কিছুই মিটবে না। বরং খাদ্যাভ্যাসের ত্রুটির দিক থেকে নজর সরিয়ে আরও ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু এর কার্যকারিতার কোনও বিচার না করেই আমরা এর জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করলাম।
হয়তো সমস্যার একটা কারণ হল, আমরা ভর্তুকিকে ‘দান’ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। দান করার কাজটাকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। যে গ্রহণ করল, সে তা নিয়ে কী করল, সে-প্রশ্নটা জরুরি নয়। তাই ভর্তুকিকে ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে চিন্তা করা যেতে পারে। আমরা যদি মনে করি যে বর্ণ, জাতি, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইতিহাসে কিছু মানুষ যে ভাবে বঞ্চিত হয়েছে, ভর্তুকি সেই ক্ষতির নিরসন করছে, তা হলে হয়তো আমাদের আত্মম্ভরিতা একটু কমবে। আমরা চিন্তা করতে বাধ্য হব, প্রতিটি শিশু সমান সুযোগ নিয়ে বড় হয়ে উঠতে পারার যে লক্ষ্য, তা বাস্তবিক ঘটছে কি না।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ২ অক্টোবর ২০১৪
কেন বিদেশি অনুদান প্রয়োজন
২০১২ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে, ২০১৫ সালের মধ্যে ভারতকে আর্থিক অনুদান দেওয়া বন্ধ করা হবে।
ভারতে দারিদ্র কমাতে কি বিদেশি অনুদানের দরকার আছে? ব্রিটিশ সরকারের অনুদান সংস্থা ‘ডিফিড’ (ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট) এই প্রশ্নে বেশ বিপাকে পড়েছে। ভারতীয় নেতারা প্রাক্তন শাসকদের এক হাত নেওয়ার সুযোগ ছাড়বেন না, ভারতীয় সাংবাদিকরাও ঘুরপথে ঔপনিবেশিক আধিপত্য বজায় রাখার ফন্দির নিন্দে করে সম্পাদকীয় কলাম লিখছেন। ও দিকে ব্রিটেনের খবরের কাগজগুলো শোরগোল তুলছে, পয়সা দিয়েও যদি প্রভাব-প্রতিপত্তি না মেলে তা হলে খয়রাতি করে লাভ কী?
অনুদানের যুক্তি একটাই হতে পারে। তা হল, গরিব মানুষেরা যে-ই হন, যেখানেই বাস করুন, তাঁদের নিয়ে আমরা চিন্তিত। এ দেশের রইস আদমিরা যা-ই বলুন, ভারতের ৩০ শতাংশ মানুষ এখনও অত্যন্ত দরিদ্র। দু’দশক ধরে ভারতের অর্থনীতির দ্রুত বৃদ্ধি হয়েছে, বলিউডে একাধিক বিলিয়নেয়ার তৈরি হয়েছে, মহাকাশে যান পাঠানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও ভারতের মাথাপিছু রোজগার কার্যত ব্রিটেনের মাথাপিছু রোজগারের দশ শতাংশ। এটাই কি ডিফিড-এর এ দেশে কাজ করার যথেষ্ট যুক্তি নয়? দু’দশকে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে ওঠার যে কথা চলছে (যা একটু বাড়াবাড়ি, কারণ বৃদ্ধির হার ইতিমধ্যেই কমে আসছে), তা এই কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছে যে এই বৃদ্ধির প্রধান কারণ, ভারতের জনসংখ্যা ততদিনে ১৫০ কোটি দাঁড়াবে, যাঁদের অর্ধেক বেড়ে উঠবে অর্ধাহারে, সিকি-শিক্ষিত হয়ে।
যার মানে দাঁড়ায়, ব্রিটিশ সরকার যে সহায়তা করতে পারবে তা হবে সীমিত। ইচ্ছে থাকলেও অত টাকা তারা জোগাতে পারবে না। আমাদেরই ভারতের অধিকাংশ সমস্যা সমাধানের কাজটা করতে হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। আমি বরাবরই ধনীদের উপর বেশি কর চাপানোর পক্ষপাতী (যেমন, বিত্তকর বসিয়ে)। কিন্তু পুঁজি কত সহজে অন্য দেশে পাচার হয়, এবং কর আদায় করতে যা হ্যাপা, তা মাথায় রাখলে আশঙ্কা হয়, নিকট ভবিষ্যতে কর থেকে মোট জাতীয় আয় অল্প কয়েক শতাংশ বড়জোর বাড়তে পারে। টাকার অঙ্কে সেটা অনেক বড়, কিন্তু সমস্যাও খুব কম নয়— শিক্ষার দশা করুণ, স্বাস্থ্য পরিষেবাও তথৈবচ, আর পরিকাঠামোর কথা না-ই বা তুললাম। পুষ্টির বিষয়টাই ধরা যাক— ভারতের শিশুদের অর্ধেকেরই অপুষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যার মানে, কয়েক কোটি শিশু। এ সবের সামনে দাঁড়িয়ে যে-কোনও সহায়তাই মূল্যবান মনে হয় না কি? কিছু নাক-উঁচু লোকের ‘ব্রিটিশ দাক্ষিণ্যে’ গোঁসা হয় বলে আমরা অনুদান থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেব?
বিদেশি অনুদানের বিরুদ্ধে যুক্তি অবশ্য এখানেই শেষ হয় না। অনেক গবেষক (এবং বেশ কিছু সম্পাদকীয় লেখক) মনে করেন যে ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে দেওয়া হলেও, বিজাতীয় বলেই অনুদান কাজ করে না। অর্থনীতির আরও অনেক ধারণার মতোই, এ ধারণাটারও সমর্থনে বা বিপক্ষে যথেষ্ট সাক্ষ্য নেই। তাই এর উপর ভর করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া চলে না বলেই মনে হয়। উন্নত দেশেও দারিদ্র কমানোর অনেক প্রকল্প ব্যর্থ হয়। বিদেশি অনুদানের টাকায় চলা প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে, এমন অনেক দৃষ্টান্ত মিলবে। যেমন মিলবে সরকারি টাকায়, বা অন্য সূত্রে মেলা অনুদানে রূপায়িত প্রকল্পে ব্যর্থতার বহু দৃষ্টান্ত। বিদেশি অনুদানের টাকায় চলা প্রকল্পগুলোই ব্যর্থ হচ্ছে বেশি, এমন কোনও প্রমাণ হাতে নেই।