গরিবকে ভর্তুকি দেওয়ার বিরুদ্ধে অবশ্যই অনেক ভাল যুক্তি রয়েছে। ভর্তুকি দিলে বাজেটে ঘাটতি বাড়ে, যার ফল মুদ্রাস্ফীতি। টাকার দাম কমলে গরিবের রোজগারও কার্যত কমে, তাই ভর্তুকি থেকে শেষ অবধি গরিবের লাভ হয় সামান্যই। এটা আরও বেশি সত্য হয়ে ওঠে সেই সব ক্ষেত্রে, যেখানে ভর্তুকি যাদের পাওয়ার কথা তারা পায় না। যেমন রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি, যা কার্যত গরিবের জন্য নির্দিষ্ট টাকা বিলি করে মধ্যবিত্তকে। তবে গরিবকে ভর্তুকি দিতে কত টাকা খরচ হচ্ছে, তার চাইতে অনেক বড় প্রশ্ন, কী ভাবে খরচ হচ্ছে টাকাটা। ঠিক মতো ব্যবহৃত হলে ভর্তুকির টাকা গরিব তার সীমিত সুযোগকে আর একটু কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু পরিকল্পনার ছক যদি ভুল হয়, তা হলে ভর্তুকির টাকা তার সামান্যই কাজে লাগবে, এমনকী পরিস্থিতি আরও খারাপও করে তুলতে পারে।
একটা দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। প্রায় কেউই প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তুকির বিরোধিতা করেন না। এমনকী মিলটন ফ্রিডম্যানের মতো যাঁরা মুক্ত বাজারের কট্টর সমর্থক, তাঁরাও মনে করেন যে গরিব পরিবারে জন্মানোর জন্য কোনও শিশু জীবনে পিছিয়ে পড়বে, এটা মেনে নেওয়া চলে না। তাই সরকারের প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু একটা করা দরকার।
প্রাথমিক শিক্ষায় কত সরকারি টাকা খরচ হয়, নানা রাজ্যে তার নানা হিসেব পাওয়া যায়। তবে জাতীয় গড়ের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, মাথাপিছু মোট জাতীয় উৎপাদনের যত শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষায় এ দেশে খরচ হয়, তা চিনের চাইতে বেশি, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনীয়। এই টাকার একটা বড় অংশ যায় শিক্ষকদের বেতন দিতে। সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা গড়ে যা বেতন পান, তা জাতীয় মাথাপিছু রোজগারের অন্তত চারগুণ। বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক, বা সরকারি স্কুলের প্যারাটিচার সেখানে সরকারি শিক্ষকদের এক-তৃতীয়াংশ মতো টাকা পান, যা জাতীয় মাথাপিছু রোজগারের কাছাকাছি। কিন্তু অর্থনীতিবিদ কার্তিক মুরলিধরন এবং তাঁর সহকর্মীদের সমীক্ষা থেকে দেখা গিয়েছে, প্যারাটিচার বা বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা শিশুদের যা শেখান, তার মান অতটাই ভাল, অনেক সময়ে আরও ভাল। যদিও গড় মান খুব কিছু ভাল নয়। ‘অসর’ রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, পঞ্চম শ্রেণির অর্ধেক ছেলেমেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্য পড়তে পারছে না। সম্ভবত বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক বা প্যারাটিচার আরও ভাল পড়ানোর কারণ, তাঁরা চেষ্টা করেন আর একটু বেশি।
শিক্ষকরা যদি ক্লাসেই না আসেন, বা আসলেও খারাপ পড়ান, তা হলে কেন আমরা তাঁদের এমন ভাল মাইনে দিচ্ছি? একটা উত্তর মেলে, শিক্ষকদের ইউনিয়ন খুব জোরালো। কিন্তু শেষ অবধি যে এই ব্যবস্থাটা চলতে পারছে তার কারণ আমরা এটাতে আপত্তিকর কিছু দেখছি না। ‘শিক্ষা বিশেষজ্ঞ’-দের অনুসরণ করে আমরাও মনে করছি (এবং সরকারও মনে করছে), যে শিক্ষকের পরিচয় তাঁর ডিগ্রি এবং তাঁর বেতনে। তিনি কতটা শেখাতে পারছেন, সেটা দিয়ে তাঁর বিচার হয় না।
শিক্ষকদের বেতন যদি প্যারাটিচারদের বেতনের সমান করা হত, তা হলে মোট জাতীয় উৎপাদনের অন্তত ১ শতাংশ বাঁচত, যা গরিবদের ফিরিয়ে দেওয়া যেত। এতগুলো টাকা যে নষ্ট হচ্ছে, সে-সমস্যা তো রয়েইছে। কিন্তু তা নিয়ে যে রাজনীতিটা হল, সেটা আরও ভয়ঙ্কর। যখন দেখা গেল, সরকারি স্কুলে ছাত্রদের সংখ্যা দ্রুত কমছে (ভারতের গ্রামেও এখন তিনজন শিশুর একজন প্রাইভেট স্কুলে যায়), স্বাভাবিকভাবেই একটা আশঙ্কা দেখা দিল, কত দিন এ ভাবে সরকারি টাকা নেওয়া চলবে। তখন সরকারি শিক্ষক এবং তাঁর বেরাদরি ‘শিক্ষার অধিকার’ নামক কলটি ফেঁদে বসলেন।
ওই আইনে যে কিছু কিছু ভাল আইডিয়া নেই, এমন নয়। কিন্তু তার একটি বড় দাবি হল, বেসরকারি স্কুলগুলোকে সরকারি স্কুলের সমান বেতন দিতে হবে শিক্ষকদের। এই ধারা কার্যকর হওয়ার পর থেকে বেসরকারি স্কুলগুলো বন্ধ হতে শুরু করেছে, কারণ প্রাইভেট স্কুলগুলোর পক্ষে অত বেশি টাকা দেওয়া অসম্ভব। গরিবের জন্য ভর্তুকি এই ভাবে উলটে গরিবকেই মারছে। কারণ গরিবের কথা ভেবে সরকারি শিক্ষককে যে টাকা দিচ্ছে সরকার, তার জেরে গরিবকে পরিষেবা দিত যে সব স্কুল সেগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
তার মানে এই নয় যে গরিবের জন্য ভর্তুকি হল বাজে খরচ। আমরা যদি কেবল এটাই দেখি যে কোন সরকারি প্রকল্প গরিবের অনেকখানি উপকার করেছে (প্রকল্পের জন্য কত খরচ হয়েছে, সেই টাকা আর কোনও ভাবে খরচ করলে বেশি লাভ হত কি না, সে-প্রশ্নগুলো যদি না-ই ধরা হয়) তা হলেও বেশ কিছু সরকারি প্রকল্পের নাম সামনে আসে। যেমন যে সব কৃষি প্রকল্প উচ্চফলনশীল প্রজাতির গম, ও পরে ধান তুলে দেয় চাষিদের হাতে। সত্তর-আশির দশকে গ্রাম-মফস্সলে ব্যাঙ্কের শাখার বিস্তার। স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের সাইকেল বিলির প্রকল্প বিহার সরকারের। আর সাম্প্রতিক, বিতর্কিত একশো দিনের কাজের প্রকল্প। এমনকী শিক্ষার অধিকার আইনও গরিবের উপকার করতে পারে, যদি নামীদামী বেসরকারি স্কুলগুলোতে গরিবের জন্য এক-চতুর্থাংশ আসন সংরক্ষিত রাখার শর্ত সর্বত্র পালন করা হয়। এখনও অবধি তা হয়নি।
তবে লক্ষ করা দরকার, এই সবগুলি প্রকল্পই কোনও-না-কোনও নির্দিষ্ট, পরিচিত সমস্যার সমাধান করেছে। গরিবের টাকা সঞ্চয়ের সুরক্ষিত জায়গার অভাবের সমস্যা ঘুচিয়েছে ব্যাঙ্কের শাখা। দূরের স্কুলে যাওয়ায় ছাত্রীদের সমস্যা অতিক্রম করেছে সাইকেল। সেই দৃষ্টিতে বিচার করলে বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের সরকারি হারে মাইনে দেওয়ার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষত যখন এমন কোনও প্রমাণ মিলছে না যে বেশি বেতনের সরকারি শিক্ষকেরা আরও ভাল পড়াচ্ছেন— বরং বিপরীত সাক্ষ্যই মিলছে।