দারিদ্রকেও দায়ী করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ নিশ্চয় ভারতের চেয়ে ধনী নয়। সেখানে মাত্র চার শতাংশ মানুষ মাঠে যান। ভারত সরকার যে-টয়লেট গরিবদের দেন, ইট-সিমেন্টের নির্মাণ থাকায় তা নাকি বাংলাদেশে ব্যক্তিগত খরচে তৈরি অনেক টয়লেটের চেয়ে বেশি দামি। আবার ভারতেই মুসলিমরা গড়ে হিন্দুদের চেয়ে গরিব হলেও, তাঁদের টয়লেট ব্যবহারের হার বেশি। গ্রামীণ হিন্দু পরিবারের ৭৭ শতাংশ বাইরে মলত্যাগ করেন, মুসলিমদের ৫৫ শতাংশ। বাড়িতে সরকারের দেওয়া টয়লেট থাকা সত্ত্বেও বাইরে যান ৪০ শতাংশ হিন্দু, মাত্র ৭ শতাংশ মুসলিম। কেন এই তফাত?
কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডায়ান কোফি পাচ্ছেন সেই শুচিতার ধারণার গ্যাঁড়াকল। যার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে অস্পৃশ্যতার ভূত। টয়লেটের লাগোয়া নিকাশি নেই বহু বাড়িতে, ব্যবহার করতে হয় সেপটিক ট্যাঙ্ক। হিন্দুদের চোখে ট্যাঙ্ক সাফাই ‘ছোট জাত’-এর কাজ, যাঁদের তাঁরা সহজে বাড়ির কাজে ডাকতে চান না। দেখা গিয়েছে, ভারতে ব্যক্তিগত খরচে তৈরি টয়লেটের সেপটিক ট্যাঙ্ক সাধারণ ট্যাঙ্কের চেয়ে অনেক বড় হয়, যাতে দীর্ঘ দিন পরিষ্কার না করলেও চলে। বহু স্কুলে টয়লেট তৈরি হয়ে পড়ে আছে, সে-ও এই মানসিকতা থেকেই। শিক্ষকদের প্রশ্ন, পরিষ্কার করবে কে? ‘ছোট’ কাজটিতে শামিল হতে তাঁদের বড় আপত্তি। যে-স্কুলে টয়লেট ব্যবহার হচ্ছে, সেখানে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকরাও ঝাড়ুটি হাতে ধরছেন। ‘কে করবে’ প্রশ্নটা আর রাস্তা আটকে দাঁড়াতে পারে না।
যা ছিল ‘বড় বাইরে’, তাকে ‘বড় ভিতরে’ করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ মানুষ মারা যদি পাপ হয়, তা হলে মাঠে যাওয়ার চেয়ে বড় পাপ বোধহয় আর কিছু নেই। এই একটা কাজ যে কত শিশুর মৃত্যু ডেকে আনছে, আরও কত শিশুকে রোগা, বেঁটে করে রাখছে, গবেষকরা তার নতুন নতুন সাক্ষ্য বার করে আনছেন। এ দেশে প্রতি বছর ৪০ লক্ষ শিশু উদরাময়ে মারা যায়। কয়েক কোটি অনবরত পেটের রোগে ভোগে। বিজ্ঞানীরা দেখছেন, যেখানে উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের অভ্যাস যত বেশি, সেখানে শিশু-অপুষ্টির হারও বেশি। মল থেকে ছড়ানো জীবাণুতে বারবার পেট খারাপ, তা থেকে এক রকম দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি তৈরি হচ্ছে। না হলে আফ্রিকার গরিবতর দেশের শিশুরা কী করে ভারতীয় শিশুদের চেয়ে লম্বা হয়? গবেষকরা অনেক মাপজোক, হিসেবনিকেশ করে বলছেন, ভারতে টয়লেট ব্যবহার বাড়লে শিশুরা আরও বেশ কিছুটা লম্বা হত। আর সুপুষ্ট, লম্বা শিশুরা লিখতে-পড়তে, অঙ্ক কষতে পারে আরও ভাল, সে-ও প্রমাণিত।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে টানিছে পশ্চাতে’। সে-কথা যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। কলুষের আশঙ্কায় ঘরে ছোট জাতকে ডেকে এনে ঘর অশুচি করার ভয়ের শেষ পরিণতি: সন্তানের রোগ, মৃত্যু। আর গোটা বিশ্বের কাছে ভারতের পিছিয়ে পড়া। কী হবে তোমার মঙ্গলে গিয়ে, ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতে, যদি শিশুদের বাঁচাতে না পারো? কী হবে আমেরিকা-চিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, যদি বাংলাদেশ-কিনিয়ার কাছে হেরে বসে থাকো?
এই প্রশ্নগুলো ‘স্বচ্ছ ভারত’ তুলবে কি না, সেটাই প্রশ্ন। ‘নির্মল ভারত’-এও টয়লেট ব্যবহারের প্রচারকে খাতায়-কলমে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। কাজের বেলায় তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল টয়লেট তৈরির প্রকল্প। তাতে নেতা-অফিসার-ঠিকাদার চক্রের পোয়াবারো। এই মুহূর্তে ভারতে প্রায় ৩ কোটি ৭৫ লক্ষ ‘মিসিং টয়লেট’ রয়েছে। মানে, হিসেবের খাতায় সেগুলো আছে, বাস্তবে কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। ‘স্বচ্ছ ভারত’-এও দেখা যাচ্ছে, মানুষের আচরণ বদলানোর কাজকে গুরুত্বের বিচারে এক নম্বরে রেখেও কাজের বেলায় বরাদ্দ কেবল ১৫ শতাংশ টাকা। তাড়া পড়ছে দিনে ৪৮ হাজার টয়লেট নির্মাণে। ক্রমাগত টয়লেট জোগান না দিয়ে, কী ভাবে টয়লেটের চাহিদা বাড়ানো যায়, সেটা চিন্তা না-করলে ফের একগাদা টাকা বাজে খরচ হবে ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্পের নামে।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ নভেম্বর ২০১৪