গরিবের সঙ্গে এমনই রসিকতা করেন দেশের কর্তারা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ঘোষণা করেছেন, এনআরইজিএ প্রকল্পে দুর্নীতি আটকাতে হবে। মানে সরকার আরও কোমর বেঁধে দেখবে, কাগজের সঙ্গে কম্পিউটার, কম্পিউটারের সঙ্গে কাজ মিলল কি না। কাটা-মাটি পুকুর হয়ে উঠল কি না, তা কিন্তু দেখবে না। জুয়াচুরি ভারী খারাপ, বোকামি আরও ভয়ানক।
দুপুর গড়াতে রোদ গনগনে, গরম বাতাস উপরে উঠছে, উত্তরখরা খালের সামনে সেই কাঁপা বাষ্পের পরদা চোখে যেন ধাঁধা লাগাল। ওই যে লোকটি কোঁকড়া চুল, কথা বলতে বলতে কোদাল চালাচ্ছেন ধাঁই ধাঁই, ওই আমাদের পঞ্চায়েত মন্ত্রী নয়? ওই যে সাদা-দাড়ি বৃদ্ধ মাথায় নীল গামছার ফেট্টি বেঁধেছেন, কাদামাটি তুলে দিচ্ছেন আর এক জনের ঝুড়িতে, ওনাকেই কি দেখিনি লালকেল্লায়? সাদা শাড়ি, কষে চুল-বাঁধা মেয়েটি ঝপ করে কাদামাটি ফেলে তরতর করে নেমে গেল নীচে, ওই দ্রুত হাঁটাচলা যে রোজ দেখা যায় টিভির পরদায়। এখানে এঁরা কেন? তবে কি এঁরা বুঝেছেন, নির্জলা পুকুর তৈরির সঙ্গে তাঁদের রাজনীতির কোনও তফাত নেই? হয়তো ওঁরাও জানেন, জলহীন পুকুর কাটার মতোই লাভ নেই রেশন ব্যবস্থা চালু রেখে যদি তাতে অপুষ্টি দূর না হয়, সর্বশিক্ষা মিশন চালিয়ে যদি তা শিশুদের লিখতে-পড়তে না শেখায়, গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনে টাকা ঢেলে যদি তা আরোগ্য না আনে। প্রকল্প মানুষের জন্য কী করতে পারল, সে-কথাটা ভুলে গিয়ে প্রকল্প চালানোটাকেই ‘কাজ’ বানিয়ে ফেলেছেন দেশের কর্তারা। তাঁদের ‘কাজ’ মানুষের কতটা কাজে লাগে, তা টের পেয়েই হয়তো চড়া রোদে নির্জলা পুকুর কাটছেন একটা দিন। নেতা হলেও, মানুষ তো।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪ জুলাই ২০১২
লোকে কেন টয়লেট চায় না
ভারতে শুদ্ধ জীবনযাত্রার অন্যতম ‘রোল মডেল’ হিন্দু ঘরের বয়স্ক বিধবারা। ‘ছোঁয়ানেপা’ এড়াতে তাঁরা সব সময়ে কেমন কাঁটা হয়ে থাকতেন, তার গল্প পাওয়া যায় কল্যাণী দত্তের ‘থোড় বড়ি খাড়া’ বইটিতে। ‘গেরস্তের শোবার ঘরে বিছানা মাদুর সতরঞ্চি পরদা, সব এঁটোকাঁটা হয়ে যায় মায় দরজার কড়াটি পর্যন্ত। তক্কে তক্কে থেকে কোন ফাঁকে এঁরা লাফিয়ে বা ডিঙিয়ে কোনও সময় ঘরে ঢুকে কাঠের পিঁড়েয় উঁচু হয়ে বসতেন।’ এমন প্রাণপণ চেষ্টায় যিনি পবিত্র থাকতেন, তাঁরই আবার ‘পায়ে লম্বা লম্বা ফাটা, জল ঘেঁটে ঘেঁটে হাত-পায়ে হাজা, অর্দ্ধেক সময় ভিজে কাপড়ে থাকার জন্য সর্দিজ্বর লেগেই থাকে।’ বহু রকম এঁটো-সগড়ি মানতেন, কিন্তু শনি-মঙ্গল-বৃহস্পতি, আর ছেলের জন্মবারে নখ কাটা বারণ, তাই হাতে-পায়ে লম্বা নখ, পরনের কাপড়খানি আধময়লা। এঁরা জমিদার ঘরের বিধবা, বলছেন কল্যাণী। তাঁরা মলিন, রুগ্ণ থাকতেন অভাবে নয়, সংস্কারবশে।
সমাজ-পরিবারের চোখে যা ‘শুচি’, তার সঙ্গে যে পরিচ্ছন্নতা, সুস্বাস্থ্যের তেমন কোনও যোগই নেই, ‘স্বচ্ছ ভারত’ তৈরির পথে এটাই এখন সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দেখা দিচ্ছে। এ দেশের এত মানুষ এখনও কেন টয়লেট ব্যবহার করছেন না, তা খুঁজতে গিয়ে এই কারণটাই ক্রমশ আর সব কারণকে ছাপিয়ে উঠছে। গুজরাত, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের গ্রামের মানুষ গবেষকদের বলেছেন, বাড়ির কাছে টয়লেট থাকাটাই তো নোংরা। অন্য দিকে, খোলা মাঠে যাওয়ার অনেকগুলো সদ্গুণ দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা। যে খোলা মাঠে যায় সে অলস নয়, নিয়ম করে ভোরে ওঠে, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, উন্মুক্ত পরিবেশ, খোলা হাওয়া পছন্দ করে। সে সতেজ, স্বাস্থ্যবান, প্রাণবন্ত। অর্থাৎ বহু দিনের সংস্কার, অভ্যাস যা বলছে, সরকারি প্রকল্প বলছে তার ঠিক উলটো। তাই প্রকল্প যত টয়লেট তৈরি করছে, তত ব্যবহার হচ্ছে না।
গবেষকরা নানা রাজ্যে গ্রামের মানুষের সঙ্গে বিশদে কথাবার্তা বলে জানছেন, যে সব বাড়িতে টয়লেট আছে, তার অর্ধেকেরও বেশি (৫৬%) পরিবারের অন্তত এক জন সদস্য বাড়ির বাইরে যাচ্ছেন কাজ সারতে। বলাই হয়, ‘বড় বাইরে’ আর ‘ছোট বাইরে’।
কংগ্রেস সরকারের ‘নির্মল ভারত’ প্রকল্পের সময়ে চিন্তাটা ছিল এইরকম: আহা গরিব মানুষ, বাড়িই নেই, টয়লেট পাবে কোথায়। ওদের টয়লেট বানিয়ে দাও, নিশ্চয়ই ব্যবহার করবে। অতএব রাজ্যে রাজ্যে, জেলায় জেলায় টয়লেট নির্মাণ শুরু হল। কিন্তু ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে, জোগান যতই বাড়ুক, চাহিদা বাড়ছে না। বরং জোগান-দেওয়া টয়লেট অব্যবহারে, অনাগ্রহে অকেজো হয়ে পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গেই যে ১০৭৭ গ্রাম পঞ্চায়েত ‘নির্মল গ্রাম’ বলে ঘোষিত হয়েছিল, সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, তার ২৫-৩০ শতাংশ বাড়িতেই টয়লেট আর কাজ করছে না। ফের এই সব গ্রামে অন্তত ১৪ লক্ষ টয়লেট তৈরি করতে হবে। ফলে বিজেপি-র ‘স্বচ্ছ ভারত’ পরিকল্পনায় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে টয়লেট গড়া নয়, টয়লেট ব্যবহার।
টয়লেট থাকতেও কেন ব্যবহার হয় না, তা নিয়ে নানা আলগা গল্প হাওয়ায় ভাসে। যেমন, গরিব মানুষ একটা বাড়তি ঘর পেলে বরং তাতে ছাগল-মুরগি রাখবে, খড়বিচুলি রাখবে, টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করবে কেন? কিংবা, সরকারি টয়লেটের এমন খারাপ দশা, ব্যবহারই করা যায় না। কিংবা জলই নেই, টয়লেট ব্যবহার করবে কী করে? এগুলো কিন্তু ধোপে টেকে না তেমন। ধরুন, জলের কথাই। পশ্চিম ও উত্তর ভারতে ‘মাঠে যাওয়া’ লোকেদের মধ্যে সমীক্ষায় মাত্র ৩ শতাংশ বলেছেন, জল না-থাকা টয়লেট এড়ানোর কারণ। যে সব বাড়িতে পাইপবাহিত জল আসে, সেখানেও বাড়ির টয়লেট ব্যবহারের হার অন্যদের প্রায় সমান। এ রাজ্যের বীরভূমে ৬৫ শতাংশ মানুষ বলছেন, তাঁদের বাড়ির ভিতরে অথবা কাছে জলের উৎস রয়েছে। অথচ প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করেন। গোটা ভারতেও এই ছবি: বাড়ির কাছে জল থাকলেও লোকে ছুটছে মাঠে। অথচ আফ্রিকায় সাহারার নীচের গরিব দেশগুলিতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের চেয়ে ঢের কম লোক বাড়ির কাছাকাছি জল পান, কিন্তু উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করেন ঢের কম লোক। ভারতের গ্রামে ৬০ শতাংশ বাইরে যাচ্ছেন, সেখানে ওসব দেশে ৩৫ শতাংশ।