আরও কতটা কাটতে হবে? ‘এখানে জলের লেয়ার আছে বারো ফুট তলায়। দশ ফুট মতো কাটলে খালে জল থাকত অন্তত অঘ্রান অবধি, আমন ধান ঘরে তুলেও গম, সর্ষে, আলু বোনা যেত,’ বললেন হারু, চণ্ডীরা। ‘কিন্তু তার জন্য ২০ দিন কাজ করতে হত কম করে। সে কি আর হবে? সাত দিনের বেশি কাজ হবে না।’ সুপারভাইজারও জানালেন, নয় দিন কাজ হওয়ার কথা এই খালে। সব গ্রামে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কাজ করতে হবে, তাই এমন ‘রেশন’ হচ্ছে কাজ, যুক্তি দিচ্ছে পঞ্চায়েত। কিন্তু আসল কথাটা হল, জল নিয়ে মাথাব্যথা নেই কর্তাদের। বীরভূমেরই এক পঞ্চায়েত সচিব, যিনি পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েতে কাজ করেছেন, স্পষ্ট বললেন, ‘এনআরইজিএ নীতিতে যদিও সেচের পুকুরকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু আসলে এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সংখ্যার খেলা। মজুরিতে যত খরচ হবে তত ভাল। কত দিন কাজ দেওয়া হল, তা দেখতে গিয়ে জলসম্পদের কথা সবাই ভুলে যাচ্ছে। ব্লকে নানা ওয়ার্কশপে যাই, কই সেখানেও তো জলের কথা শুনি না।’
অপর একটি পঞ্চায়েতের সচিবও বললেন, ‘পুকুরে জল উঠবে না জেনেও কাজ দিতে হয়। না হলে এত কাজ কোথায়? উপরওয়ালারা তো বলেই দিচ্ছেন, ৫০ দিন কাজ দিতে হবে, কেমন করে দেবে আমার দেখার দরকার নেই।’ বোলপুরের কাছে দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েতে কাজ করেছেন তিনি, বললেন ‘এই দুই অঞ্চলে ৪০ শতাংশ মতো পুকুরে জল আছে। বাকিগুলো জল থাকবে না জেনেও খোঁড়া হচ্ছে।’
উত্তরখরা খাল এ বারও ফুট ছয়েক গভীরতায় থমকে যাবে। তিন বছর আগে এই খালই কাটা হয়েছিল এনআরইজিএ’র টাকায়। খানিক দূরে আড়াই-তিন বিঘে জুড়ে শালুকগড়া খালও সংস্কার হয়েছিল। তারও আজ সেই একই দশা, নীচে পাঁকটুকুও শুকিয়ে কাঠ। এর আগে যা হয়েছিল, এ বারও তাই হবে, ধান রোয়ার সময়ে জল পাওয়া যাবে ওই খালগুলো থেকে, কিন্তু কার্তিকে ধান তোলার সময়ে খালে জল থাকবে না, বিঘে প্রতি ফলন হবে বড়জোর পাঁচ-ছয় বস্তা (তিন কুইন্টাল)। খালে জল থাকলে আশেপাশের ৩০ বিঘে জমিতে দুটো ফসল হতে পারত, আফশোস করছিলেন ওঁরা। ‘হয় আমাদের এক মাস খুঁড়তে দিক, নইলে মেশিন নামিয়ে তলাটা কেটে দিক। আমরা মাটি ফেলে দেব,’ বিড়িটা ছুড়ে ফেলে বললেন সন্ন্যাসী বাউরি। কিন্তু শ্রমিকদের সুযোগ বেশি দিতে হবে বলে বুলডোজার ব্যবহারের সুযোগ নেই প্রকল্পে। তাই কোনও গ্রামেই যতটা কাটা দরকার পুকুর, ততটা কাটা হয়ে ওঠে না।
মহাত্মা গাঁধীর নামাঙ্কিত প্রকল্প বাউরি, মার্ডি, হেমব্রমদের ‘লেবার’ করে রেখে দিল। দিন আনি দিন খাই-এর বাইরে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ করে দিল না।
এই চিত্র সর্বত্র। বীরভূমের ৪৪টি গ্রামে একটি সমীক্ষা করেন অর্থনীতির গবেষক শুভাশিস দে, ২০১০ সালে। সময়টা ছিল অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর, সে-বছর বর্ষা শেষ হওয়ার পরে পরেই। একশোটিরও বেশি এনআরইজিএ-র পুকুর তিনি নিজে দেখেন। সেই গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিতে তার আগের চার-পাঁচ বছরে পুকুরের কাজে খরচ হয়েছিল এনআরইজিএ-র জন্য বরাদ্দ টাকার ৭৪-৮৯ শতাংশ। তা সত্ত্বেও নতুন পুকুরের ৮৮ শতাংশে জল ছিল না, পুরনোগুলো তো প্রায় সবই শূন্য। সম্বৎসর জল থাকে, এমন পুকুর মেরেকেটে তিন শতাংশ। যদিও প্রায় ৩০ শতাংশ পুকুরের চারপাশে চাষের জমি ছিল, কিন্তু মাত্র ১১ শতাংশ পুকুরের জল পাচ্ছিলেন চাষিরা।
উত্তরখরার আদিবাসী পাড়ার মণি হাঁসদা, মালতী হেমব্রমদের গ্রামের ডোবা কোটালগড়ায় বছর দুই আগে সাত দিনের কাজ হয়েছিল, কিছু দিন জল ছিল। এখন একটা গামছা ধোয়ারও জল নেই। ‘আগুন লাগলে চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে,’ বললেন ওঁরা। দেড়শো পরিবারের জন্য দুটি টিউবকল। পাশের ইটোন্ডা গ্রামের চন্দনা, তন্দ্রা রাজবংশীরা জানালেন, পাড়ায় দশ-বারোটা পুকুর, কোনওটায় জল নেই। সকাল ছ’টা থেকে ৯টা, দুপুর একটা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা ওঁরা টিউবকলে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ‘আর দু’তিন ফুট পুকুর কাটলে জল মিলত।’ উত্তরখরা খালের মাটি কাটতে কাটতে পঞ্চায়েত সদস্য সুন্দরী মার্ডি বললেন, ‘এখানে খানিক, ওখানে খানিক, এমনি কাজ দেয়। এক মাস কাজ না করলে জল দাঁড়াবে কী করে?’
যতটা মাটি কাটলে জল দাঁড়ায়, ততটা কাজ হয় না কেন? কী ভাবে স্থির হয় কতটা মাটি কাটা হবে? এক পঞ্চায়েত সচিব বললেন, ‘নির্মাণ সহায়ক পুকুরটা মেপে নেয়, জেনে নেয় কত টাকা চেয়েছি, তার পর ঠিক করে কতটা কাটা হবে। জলস্তর দেখে পুকুর কাটা, তেমন আমি দেখিনি।’ এনআরইজিএ কমিশনার দিব্যেন্দু সরকার অবশ্য জানালেন, আট-দশ লক্ষ টাকার প্রস্তাব ব্লক বা জেলাকে দিয়ে মঞ্জুর করিয়ে দরকার মতো পুকুর খোঁড়া যায়। কিন্তু উপরের কর্তাদের দিয়ে কাজের প্রস্তাব অনুমোদন করানোর ঝামেলায় যেতে চায় না অনেক গ্রাম পঞ্চায়েত। আড়াই লক্ষ টাকার মধ্যে কাজের প্রস্তাব মঞ্জুর করতে পারে গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্মাণ সহায়ক, তাই তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় কাজ। তবে তিনি এ-ও স্বীকার করেন যে, পুকুর কাটা হয়ে যাওয়ার পর তা সত্যিই জলসম্পদ তৈরি করে গ্রামের মানুষের প্রয়োজন মেটাচ্ছে কি না, তা পরখ করার কোনও ব্যবস্থাই চালু নেই। গ্রামে নয়, রাজ্যে নয়, কেন্দ্রে নয়।