সমাজ ও দেশের এই বিচিত্র, বহুমুখী, সতত-পরিবর্তনশীল চরিত্রকে হিসেবের মধ্যে না ধরে যাঁরা মনে করেন, কোনও এক ভাবে ঘটনাস্রোতকে বইয়ে দিতে পারলে ইতিহাসের মোড় ঘুরে যাবে, সমাজ কোনও এক নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে, তাঁরা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছেন বারবার। কার্ল মার্ক্স শ্রেণি সংঘাতের যে তত্ত্ব দিয়েছেন, সেখানে সমস্যা নেই। সমস্যা ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর ‘বৈজ্ঞানিক’ ধারণা, যা প্রশ্নাতীতভাবে দেখিয়ে দিতে চায় ইতিহাস কোন পথে চলবে।
জেফ্রি সাকস বিপুল আর্থিক অনুদান দিয়ে দারিদ্র ঘোচানোর যে পথ দেখিয়েছেন, সেখানেও তেমন গোল বেধেছে। মার্ক্সের মতোই সাকস-ও মনে করেন যে ইতিহাসের গতি কোন দিকে তার সুনির্দিষ্ট ধারণা করা সম্ভব। কোন সময়ে, কী পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনলে কোন দিকে ভবিষ্যতের ঘটনাক্রম যাবে, তা বলে দেওয়া যায়। গোল বাঁধে তখন, যখন দেখা যায় যে তেমন বাতলে-দেওয়া পদ্ধতি প্রয়োগ না করেও পরিবর্তন আসছে।
যেমন, গরিবের জীবনের মান ভাল করতে যেসব প্রকল্পের কথা তিনি বলেছেন তা যে দারিদ্র, দুর্নীতিপূর্ণ দেশে ব্যাপক আকারে প্রয়োগ করা যাবে, তা কি ধরে নেওয়া চলে? অথচ তা না করে গেলে পরিবর্তন কী করে সম্ভব? ধরা যাক একটা দেশের কথা— উগান্ডা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের হিসেব মতো ২০১০ সালে উগান্ডা ছিল দুর্নীতির সূচকে ১৭৮টা দেশের মধ্যে ১২৭। সাকসের দারিদ্র-দুর্নীতি চক্রের তত্ত্ব মেনে নিলে বলতে হয়, যতদিন না দুর্নীতি কমছে, ততদিন গরিবের শিক্ষা, স্বাস্থ্যে কোনও পরিবর্তন সম্ভব নয়।
॥ ২ ॥
অথচ আমাদের চারদিকে তেমন ‘অসম্ভব’ ঘটনাই ঘটে চলেছে। ধরা যাক উগান্ডার গল্পটাই।
নব্বইয়ের মাঝামাঝি আফ্রিকার উগান্ডাতে কাজ করতে গিয়ে ইউরোপের দুই গবেষক দেখেন, সে দেশে সরকার স্কুলগুলোর উন্নয়নের জন্য যে টাকা বরাদ্দ করছে, গড়ে তার মাত্র ২৪ শতাংশ পৌঁছচ্ছে তাদের কাছে। গরিব স্কুলগুলো পাচ্ছে আরও কম টাকা। বহু স্কুল কোনও টাকাই পাচ্ছে না। যেমনটা হয়ে থাকে, তা-ই হচ্ছে— সরকারি কর্মী আর নেতারা সরিয়ে ফেলছে বেশির ভাগ টাকা। বিষয়টা জানাজানি হতে সে দেশের সরকার একটা অন্য ধরনের উদ্যোগ নিল। কোন স্কুলের জন্য কত টাকা মঞ্জুর হয়ে গিয়েছে, তা প্রতি মাসে ছেপে দিতে লাগল খবরের কাগজে। এ হল ১৯৯৬ সালের কথা। ২০০১ সালে ফের খোঁজ করে ওই গবেষকরা দেখলেন, এখন গড়ে স্কুলগুলো পাচ্ছে মঞ্জুর-করা টাকার ৮০ শতাংশ। যে স্কুল খবরের কাগজের দোকানের যত কাছে, সে তত বেশি টাকা পাচ্ছে। আরও দেখা গেল, কম টাকা পাওয়ার জন্য যে হেডমাস্টার মশাইরা অভিযোগ করে চিঠি দিয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই শেষ অবধি প্রাপ্য টাকা পেয়েছেন। তার জন্য তাঁদের কোনও হয়রানি সইতে হয়নি। যে সব খবরের কাগজগুলো স্কুলের বরাদ্দ নিয়ে রিপোর্ট ছেপেছিল, তাদেরও কোনও সমস্যায় পড়তে হয়নি। বোঝা গেল, কেউ যে স্কুলের জন্য বরাদ্দ টাকার বিষয়টা খেয়াল করছিল না, তার সুযোগ নিয়ে নির্ভয়ে চুরি চালাচ্ছিল সরকারি কর্মীরা।
এই গবেষণা কেবল চুরি কমায়নি, তা একটা অন্য সম্ভাবনার নির্দেশ করছে। দুর্নীতির তালিকায় একেবারে নীচের দিকে ছিল উগান্ডা। সেই দেশেও হেডমাস্টার মশাইরা দুর্নীতি রুখে দিতে পেরেছেন। রাজনৈতিক বিপ্লব হয়নি, সার্বিক বিধিব্যবস্থার বদল হয়নি। তবু পরিবর্তন হয়েছে।
এমন দৃষ্টান্ত চারপাশে। গরিব দেশগুলোতেও মানুষের আয়ু বাড়ছে, সাক্ষরতার হার বাড়ছে, শিশুমৃত্যুর হার কমছে। যে দিক থেকেই হিসেব করা যাক, চরম দারিদ্রে বাস করা মানুষের সংখ্যা গত দশ বছরে অনেকটাই কমেছে। সে দিনের মতো দুর্ভিক্ষ আজ নেই, প্লেগ কিংবা কলেরায় গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হওয়ার ঘটনাও এখন অতীত। অথচ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফাঁকফোকর রয়ে গিয়েছে, দুর্নীতি উপড়ে ফেলা যায়নি, বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্যের মতো সামাজিক সমস্যাও থেকে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও গরিবের জীবনে যতখানি উন্নতি হয়েছে, কোনও বিচারেই তাকে নগণ্য বলা চলে না।
কী করে এই উন্নতি আসছে? গরিবের জীবনে এমন উন্নতি আসছে ছোট ছোট পরিবর্তন থেকে। উগান্ডায় খবরের কাগজে মঞ্জুর-করা টাকার পরিমাণ ছাপার ফলে প্রকল্পের ফাঁকটা ভরে গিয়েছিল, তাই দুর্নীতি বন্ধ হয়েছিল। তেমনই, গরিবের জন্য তৈরি করা প্রকল্পের নকশায় কোথায় ফাঁক থেকে যাচ্ছে, তা যদি চিহ্নিত করে সেগুলো আটকানো যায়, তা হলে টাকা অপচয় আটকানো যাবে। যদি প্রকল্পের নিয়মিত মূল্যায়ন হয়, টার্গেটের সঙ্গে বাস্তবটা মিলিয়ে দেখা হয় বারবার, তা হলে ফাঁকগুলো ধরা পড়বে। প্রকল্পের পরিকল্পনায়, রূপায়ণে, মূল্যায়নে যদি অনেক বেশি মনোযোগী হওয়া যায়, তা হলে অপচয়, অদক্ষতা অনেকটাই রুখে দেওয়া যাবে। গত বছর পনেরো যা কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলেছে বিশ্বের নানা গরিব দেশ থেকে, তাতে ইঙ্গিত মিলছে যে দারিদ্র কমানোর জন্য কার্যকর উপায় এমন ছোট ছোট পরিবর্তন নিয়ে আসা, যা প্রশাসনের দায়বদ্ধতা বাড়াতে পারে, দুর্নীতি কমাতে পারে। এগুলো করা গেলে বিধিব্যবস্থার সার্বিক পরিবর্তন না এলেও দারিদ্র কমানো যাচ্ছে।
যেমন ব্রাজিলে দেখা গিয়েছে, প্রযুক্তিতে সামান্য পরিবর্তন অনেকটা বদল আনতে পারে গরিবের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতায়। সে দেশে আগে ভোট দেওয়ার নিয়ম ছিল, প্রার্থীদের নামের লম্বা তালিকা পড়ে নিজের প্রার্থীর নাম বা নম্বরটি বেছে নিয়ে তা লিখতে হবে। তারপর সেই ব্যালট পেপার বাক্সে ফেলতে হবে। স্বভাবতই এই ব্যবস্থায় সব চাইতে অসুবিধে গরিবের, কারণ লিখতে-পড়তে অসুবিধে তাদেরই বেশি। যে-কোনও নির্বাচনে ২৫ শতাংশ ভোট বাতিল হত। অর্থাৎ জনসংখ্যার একটি বড় অংশের কার্যত ভোটাধিকার ছিল না। নব্বইয়ের দশকের শেষে ইলেকট্রনিক ভোট মেশিন এল। প্রধানত গোনার সুবিধের জন্যই তা আনা হল, কিন্তু তাতে সুবিধে হল গরিবের। ভোট দেওয়া সহজ হওয়ায় তাদের ভোট আগের চাইতে অনেক বেশি গোনা হল। তাদের পছন্দের প্রার্থী— যাঁরা নিজেরা গরিব— আরও বেশি নির্বাচিত হলেন। জনস্বাস্থ্যমূলক প্রকল্পে টাকা খরচ বাড়ল। ১৯৯৪-২০০৬ সালের পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখে গবেষকরা বললেন, গরিব মায়েদের কম-ওজনের সন্তান প্রসবের হার কমেছে। নতুন প্রযুক্তিতে ভোটের জন্যই এমন হচ্ছে, দাবি করেছেন তাঁরা।