স্কুল শিক্ষা: সর্বশিক্ষা মিশন বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের (জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন, টোটাল স্যানিটেশন ক্যাম্পেন, রাজীব গাঁধী পানীয় জল প্রকল্প প্রভৃতি) টাকা সমন্বিত করে পরিচ্ছন্নতার প্রচার করতে পারে, তাই টাকার অঙ্কটা নির্দিষ্ট নয়।
শিক্ষা-সম্পর্কিত প্রচার মিডিয়ার মাধ্যমে করার জন্য রাজ্য স্তরে দু’কোটি টাকা, এবং জেলাগুলির প্রতিটিতে প্রায় সমান পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করেছে সর্বশিক্ষা মিশন। এই টাকা থেকে ব্যয় হতে পারে সু-অভ্যাসের প্রচারের জন্যও।
‘লার্নিং এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম’-এর অধীনে বই-বহির্ভূত শিক্ষার নানা দিক নিয়ে কাজের জন্য রাজ্যের হাতে গত বছর ছিল ১৩০ কোটি টাকা।
এ ছাড়াও জেলায় জেলায় সর্বশিক্ষা মিশনের ‘প্রজেক্ট অফিস’ থেকে প্রকল্প রূপায়ণ বাবদ বরাদ্দ টাকার অনেকটাই স্কুলগুলির জন্য সাবান কেনা, এবং তার ব্যবহারের বিষয়ে প্রচারের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
সমাজ কল্যাণ দফতর: Information, Education, Communication-এর জন্য প্রতিটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র বছরে হাজার টাকা পায়।
টাকার অভাব নেই। তা হলে শিশুদের কুঅভ্যাস বদলাচ্ছে না কেন? কারণ তা নিয়ে কারও খুব মাথাব্যথা নেই। শিক্ষা দফতরের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট হল, তাঁদের তাগিদ দু’রকম। এক, স্কুলগুলোতে শৌচাগার তৈরি করা। ২০০৮ সাল অবধি নির্মাণের কাজই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। দুই, কিছু কার্যসূচি পালন করে যাওয়া। যেমন ‘নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কার’-এর জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন, বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে ৭-১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্য সপ্তাহ পালন প্রভৃতি। কিন্তু শিশুদের দৈনন্দিন অভ্যাসের উপর নিয়মিত নজরদারির কোনও ব্যবস্থা নেই। বরং সর্বশিক্ষা মিশনের কর্তাদের মনোভাবটি এ রকম যে, ‘জানানো হচ্ছে যখন, শিশুরা তা করছে নিশ্চয়ই।’
কী ভাবে স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বার্তা দিলে তাতে কাজ হবে, তা নিয়ে নানা পরীক্ষা হয়েছে। অমিতাভ বচ্চনকে কাজে লাগিয়ে পোলিয়ো টিকার জন্য ‘দো বুঁদ জিন্দেগি কা’ প্রচারটি কার্যকর হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার ভরসায় বিদ্যা বালনকে দিয়ে ‘নির্মল ভারত অভিযান’ শুরু করছে কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত মন্ত্রক। আবার সাধারণ মানুষ যাঁরা অভ্যাস পরিবর্তন করে ভাল ফল পেয়েছেন (‘পজিটিভ ডিভিয়ন্স’), তাঁদের সামনে রেখে প্রচার করে ফল মিলেছে পশ্চিমবঙ্গেই, অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প দিয়ে অপুষ্টি মোকাবিলার ক্ষেত্রে। কিছু ক্ষেত্রে ছোট ছোট দলে ভাগ করে কথাবার্তা বললে কাজ হয়, যেমন গর্ভবতীদের কাছে স্বাস্থ্যের কথা পৌঁছতে হলে। কোথাও এলাকার বাসিন্দাদের সার্বিক অংশগ্রহণ দ্রুত ফল দেয়, যেমন ম্যালেরিয়া নিবারণের জন্য জমা জল পরিষ্কার করা।
কোন কৌশল কাজ দেবে, ‘স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন’-এর সেই উপায়টি ঠাহর করা সহজ নয়। তা পরিকল্পনা, পরিশ্রম এবং সময় দাবি করে। সেই দাবিই করছে পশ্চিমবঙ্গের শিশুরা। তাদের শিক্ষার অধিকারের মধ্যে পরিচ্ছন্ন পরিবেশের অধিকার ঢোকানো অর্থহীন হয়ে যাবে যদি কেবল টয়লেট তৈরি করে, আর স্বাস্থ্য বিষয়ে বসে আঁকো প্রতিযোগিতা করে দায় সারা হয়। যদি পরিকল্পনার অভাবে প্রচারের টাকা ফিরে যায়। স্কুলগুলোতে শৌচাগারও রয়েছে, মিড-ডে মিলের খাওয়াদাওয়াও হচ্ছে, অথচ শিশুরা হাত ধোয়ার অভ্যাস রপ্ত করতে পারছে না। অসুখ-অপুষ্টি-অশিক্ষার চক্র ভাঙছে না। এই একটি ব্যর্থতাই স্বাস্থ্য-শিক্ষা-তথ্য-পঞ্চায়েত-সমাজ কল্যাণ, সব দফতরকে ফেল করিয়ে দিচ্ছে।
ওই অ-ধোয়া হাতগুলোই এ রাজ্যে দারিদ্রের সূচক।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ মে ২০১২
শুকনো পুকুর
এক কথায় প্রকাশ করুন: ‘মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প।’
উত্তর: ‘পণ্ডশ্রম।’
তাই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের বুকে এত খাদ। ওগুলো হওয়ার কথা ছিল পুকুর। গ্রামের মানুষ পুকুর সংস্কার করে তাতে ধরে রাখবেন বৃষ্টির জল, মাটির তলা থেকেও জল উঠে এসে ভরে দেবে পুকুরকে, এমনই ভাবা হয়েছিল। ছয় মাসও যদি জল থাকে, সেচের জলের চাহিদা মেটে অনেকটা, শ্যালো চালিয়ে জলস্তর ক্ষয় করতে হয় না। বাসন-মাজা কাপড়-কাচার জলের চাহিদা মিটে মেয়েদের জীবনটা খানিক সহনীয় হয়। সেই উদ্দেশ্যে একশো দিনের প্রকল্পের বেশির ভাগ কাজই এ রাজ্যে হয়েছে জলাশয় সংস্কারের প্রকল্পে। খরচ হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। গত সাত-আট বছরে যত পুকুর কাটা হয়েছে, তাতে জল থাকলে বহু জমি দোফসলি হত, বৃষ্টির জন্য আকাশ-পানে তাকিয়ে বসে থাকতে হত না চাষিদের। বৃষ্টি যথেষ্ট না হলেও তা অনেক গা-সওয়া হত।
আসলে ঘটছে কী? আষাঢ়ের এক সকালে, উত্তরখরা গ্রামে তার একটা নমুনা দেখা গেল। বীরভূমের বাহিরি-পাঁচশোয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের এই গ্রামটির নামেও খরা, কাজেও খরা। পাঁচশোয়া গ্রামের পুবে, গাজিডাঙার উত্তরে আর বাহিরির দক্ষিণে বিস্তীর্ণ প্রায় হাজার বিঘে জমি, শ্যালো পাম্প বসাতে গিয়ে সেখানে জলের নাগাল মেলেনি। হারু বাউরি, চণ্ডী বাউরি, রতন বাউরিদের ভরসা আকাশ আর পুকুর। সাড়ে ন’শো ফুট লম্বা আর ১৪০ ফুট চওড়া উত্তরখরা খাল সংস্কার করতে তাঁদের মতো ২৬০ জন লেগে পড়েছিলেন একশো দিনের কাজে। খানিক বৃষ্টিতে এঁটেল মাটি একটু নরম হয়েছে, পুরুষরা কোদাল চালাচ্ছেন, মেয়েরা ঝুড়ি করে মাটি নিয়ে পাড়ে ফেলে আসছেন। মাথাপিছু গড়ে ৬২ ঘন ফুট মাটি কাটলে ওরা পাবেন ১৩৬ টাকা মজুরি। কাজ হয় গ্রাম পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে। গরিবের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় রোজগার যাতে হয়, তাই প্রকল্পটি মূলত শ্রমনির্ভর। যে-কোনও কাজের অন্তত ৬০ শতাংশ টাকা ধরতে হবে মজুরি খাতে।