নেতাদের ইচ্ছা যখন মানুষের ইচ্ছার বিপরীতে যাবে না, তাঁদের স্বার্থের সঙ্গে জনস্বার্থের বিরোধ বাধবে না পদে পদে, তখন সেই ব্যবস্থা হয়ে উঠবে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যোগ্য শাসনতন্ত্র।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ জানুয়ারি ২০১২
সাবানের কাজ
সাধারণ পরিচ্ছন্নতার নিয়মগুলো ছাত্ররা কতটা জানে, কতটা পালন করে, তা বুঝতে বীরভূমের কয়েকটি স্কুলে একটা সমীক্ষা হয়েছিল ২০১১ সালের শেষে। সর্বশিক্ষা মিশনের অনুদানে ‘আশা’ সংস্থার এই সমীক্ষায় পাঁচশোর উপর ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল, তাদের বয়স ৬ থেকে ১১ বছর। তাদের মধ্যে তফশিলি জাতি-জনজাতির ছাত্ররাও ছিল বেশ কিছু।
প্রাথমিক ফলাফল দেখে আঁতকে উঠতে হয়। দশ জনে আট জনই রাতে খাবার পরে দাঁত মাজে না, অর্ধেকেরও বেশি শৌচাগার ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয় না। বড় হতে হতে তারা যে এগুলো শিখে যাচ্ছে, এমনও নয়। দেখা যাচ্ছে, দশ-এগারো বছরের ছেলেমেয়েদের ৮৪ শতাংশ খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয় না। কোনও কোনও বিষয়ে খানিক উন্নতি হচ্ছে। প্রাথমিকের তুলনায় উচ্চ প্রাথমিকে থুতু ফেলার মতো বদ অভ্যাস কমছে, কাশির সময়ে মুখের উপর হাত চাপা দেওয়ার ভাল অভ্যাস বাড়ছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়, দশ জনে চার জন ছেলেমেয়ের মধ্যে খারাপ অভ্যাসগুলো থেকেই যাচ্ছে।
এ তথ্য উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ ভারতের সামগ্রিক ছবিটাও এর কাছাকাছি। একটি বেসরকারি সংস্থার তৈরি ‘হাংগার অ্যান্ড ম্যালনিউট্রিশন রিপোর্ট’ (সংক্ষেপে ‘হাংগামা রিপোর্ট’) নয়টি রাজ্যের ১০০টি জেলায় সমীক্ষা করেছে। দেখা যাচ্ছে, প্রায় ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রেই বাড়িতে সাবান আছে, কিন্তু শৌচাগার ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছেন মাত্র ১৯ শতাংশ পরিবার, আর খাবার আগে ১০ শতাংশ। সাবানের দরকার স্নানের জন্য, এটাই চলতি ধারণা। উদ্বেগ কিশোরী মেয়েদের নিয়েও। বীরভূমে দেখা যাচ্ছে, দশ জনে ছ’জনই ঋতুস্রাবের দিনগুলোতে ‘ন্যাপকিন’ হিসেবে যা ব্যবহার করছে, তা দোকান থেকে কেনাই হোক বা বাড়িতে তৈরিই হোক, স্বাস্থ্যসম্মত নয়। অনেকেই ব্যবহৃত জিনিসটি আবার ব্যবহার করছে, সংক্রমণের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। যথাযথ পদ্ধতি ব্যবহার না করায় অনেক ছাত্রী মাসে চার-পাঁচ দিন স্কুলে যাচ্ছে না।
এই তথ্যগুলো বীরভূমের, কিন্তু বাকি রাজ্যে ছবি খুব আলাদা নয়। তার একটা ইঙ্গিত ডায়ারিয়ার প্রকোপ। সরকারি হিসেবে, এ রাজ্যে প্রতি বছর অন্তত আড়াই লক্ষ মানুষ ডায়ারিয়ার জন্য সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার দ্বারস্থ হন, মারা যান পাঁচশোরও বেশি। শিশুদের মধ্যে ডায়ারিয়ার প্রকোপ জাতীয় হারের চাইতে বেশি। অথচ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে খেতে বসলেই ৪২ শতাংশ কমে যায় ডায়ারিয়া। স্বাস্থ্য-অস্বাস্থ্যে এত সামান্য দূরত্ব, অথচ তা ঘোচানো আর যাচ্ছে না।
কেন এই সহজ উপায়গুলো মানা হচ্ছে না? এমন তো নয় যে, স্বাস্থ্যের কোনও নিয়মই মানছে না শিশুরা। তারা রোজ সকালে দাঁত মাজে, প্রায় সকলেই নিয়মিত নখ কাটে, চোখ ধোয় পরিষ্কার জলে, পানীয় জল ঢাকা দিয়ে রাখে। এমনকী ১০-১১ বছরের ছেলেমেয়েদের অধিকাংশ (২৯৪ জনের মধ্যে ২৫২ জন) জানিয়েছে, তারা নিয়মিত মশারি ব্যবহার করে। এই বার্তাগুলো তাদের কাছে কোনও-না-কোনওভাবে পৌঁছে গিয়েছে। অথচ পৌঁছয়নি রাতে দাঁত মাজা, কিংবা শৌচের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বার্তা।
অন্য দিকে, সুস্বাস্থ্যের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যার অনেকটাই খরচ হয় না। কোন প্রকল্পে বরাদ্দের কী দশা, এক বার তাকিয়ে দেখা যাক।
তথ্য ও সংস্কৃতি: জনস্বার্থমূলক বার্তাগুলি প্রচারের মূল দায়িত্বে রয়েছে যে দফতর। এই দফতরের দেওয়া হোর্ডিং কিংবা কাগজ-টিভির বিজ্ঞাপনের বাইরেও, মুখোমুখি আদানপ্রদানের মাধ্যমে প্রচারের জন্য বরাদ্দ থাকে টাকা। ২০০৯-১০ সালের জন্য ছিল ৩৮ লক্ষ টাকা, ২০১০-১১ সালের জন্য ৪০ লক্ষ টাকা। স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রভৃতি নানা বিষয়ে এই টাকা খরচ হতে পারত। কিন্তু পর পর দু’বছর এই গোটা বরাদ্দই খরচ না হয়ে ফেরত চলে গিয়েছে। কী প্রকল্পে, কীসের প্রচারে খরচ হবে এই টাকা, তার পরিকল্পনা করে উঠতে পারেননি দফতরের কর্তারা।
পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন: এই দফতর পরিচালিত শিশুশিক্ষা কেন্দ্রগুলিতে শিক্ষা সহায়িকাদের প্রশিক্ষণের জন্য, সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে মা ও শিশুদের শেখানোর জন্য ‘ফ্লিপ চার্ট’-এর জন্য, টাকা দেয় স্বাস্থ্য দফতর। ২০০৮-০৯ সালের বার্ষিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, তিন কোটি ৮০ লক্ষ টাকার মধ্যে খরচ হয়নি দেড় কোটি টাকারও বেশি।
এ ছাড়া ‘টোটাল স্যানিটেশন ক্যাম্পেন’-এর অধীনে অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস বদলের জন্য প্রচার করতে ২০০২ সাল থেকে এখনও অবধি মোট ১৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কেবল ‘Information, Education, Communication’-এর জন্য ধার্য এই টাকার মাত্র ২০ শতাংশ খরচ হয়েছে এ রাজ্যে। প্রতিটি জেলা বছরে এই বরাদ্দ থেকে দু’কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা পায়। বীরভূম খরচ করেছে বরাদ্দের মাত্র ৬-৭ শতাংশ টাকা। ইউনিসেফ-এর এক প্রতিনিধি জানালেন, এর কারণ জেলাগুলোতে IEC-র জন্য ভারপ্রাপ্ত কেউ নেই, স্থানীয় এনজিও দিয়ে কাজ চালানো হয়। তারা কখনও ছৌ নাচ, কখনও বাউল গান, কখনও পথনাটিকা করে স্বাস্থ্য বিষয়ক বার্তা প্রচার করছে। কিন্তু তাতে কাজ কতটা হচ্ছে, তার নজরদারি (মনিটরিং) হচ্ছে না। এই ছবির দিকে তাকালে স্পষ্ট হয় যে, বরাদ্দ খরচ না-হওয়ার সঙ্গে অসুস্থতার হারে বদল না-হওয়ায় একটা সম্পর্ক রয়েছে। অন্তত খরচ না-করলে যে শিশুরা সুস্থ থাকবে না, সেটা নিশ্চিত।