ভারতে অন্য সংস্কারের কথা ভাবা যায়। যেমন, রাষ্ট্রই নির্বাচনে প্রচারের খরচ দিক প্রতি রাজ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চারটি (বা তিনটি বা পাঁচটি) রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের। টাকার অঙ্ক না হয় দরাজভাবেই ঠিক হোক। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো, টাকা ঢেলে টাকার অপচয় আটকাতে হবে। অবশ্যই এই প্রস্তাব নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠবে: নতুন দলগুলোর কী হবে? বিধানসভা নির্বাচনের টাকা কে দেবে? উত্তর খোঁজা দরকার। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারের খরচে স্বচ্ছতা আনতে টাকা দিতে হবে রাষ্ট্রকে, এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা জরুরি।
লোকপাল আইন নিয়ে আপত্তি একেবারে গোড়ায়। এ আইনের মূলে রয়েছে রাষ্ট্র সম্পর্কে অণ্ণা হজারের ধারণা: ‘রাষ্ট্রের প্রধান কাজ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা। তাই রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের যতটা সম্ভব ভয়ে রাখা, চাপে রাখা দরকার।’ কিন্তু রাষ্ট্রকে যতই নির্মম মনে হোক, শেষ অবধি তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোথায় সেতু তৈরি হবে, পানীয় জল পরিস্রুতির সেরা উপায় কী, শিক্ষা নীতি কী হবে। সরকারের কাজ হয়তো আরও সরল, আরও সীমিত করা যেতে পারে। কিন্তু তার পরেও বহু কাজ থেকে যাবে, যা সরকারকেই করতে হবে, এবং ভাল করে করতে হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়লেই যে অন্য কাজগুলো আরও ভাল ভাবে হয়ে যাবে, এমন নয়। বরং লোকপাল ভুরু কুঁচকে চেয়ে রয়েছে জানলে সরকারি কর্মীদের কম টাকায় ভাল কাজ করানোর উদ্যোগটাই চলে যাবে। সরকারি টাকা বাঁচানোর ঝুঁকি কেউ নিতে চাইবে না।
সরকারি দফতরগুলোয় বজ্র-আঁটুনি কষতে গিয়ে ফসকা-গেরো দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে তহবিলের টাকা, এমন দেখা গিয়েছে অনেক দেশে। যেমন, ইতালিতে সরকারি কর্তারা দু’ভাবে জিনিস কিনতে পারেন। এক, সরকার-নির্দিষ্ট সরবরাহ সংস্থা ‘কনসিপ’-এর থেকে। কনসিপ ঘোষিত দামে জিনিস দেবে, ঘুস দেবে না। দুই, বাজার থেকে সরাসরি দরদাম করে, সে ক্ষেত্রে ঘুস খেয়ে বরাত পাইয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ইতালি ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ বলে পরিচিত, সেখানে সরকারি কর্তারা বাজার থেকে জিনিস কিনতে আগ্রহী হবেন, এমনই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাঁরা কনসিপ থেকেই কিনছেন, বাজারের চেয়ে দেড়গুণ বেশি দাম দিয়েও। অবশ্যই দুর্নীতির অভিযোগ থেকে গা বাঁচাতে। অকারণ ব্যয়ের ফলে ইতালি সরকারের মোট জাতীয় উৎপাদনের দুই শতাংশ নষ্ট হচ্ছে। লোকপালের কড়াকড়িতে ভারতেও এমন ঘটতে পারে।
সরকারি দফতরের উপর নজরদারি অবশ্যই দরকার। কিন্তু যে সব দেশে আমলাতন্ত্র কাজ ভাল করে, সেখানে দেখা যায় কর্মীরা নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রকের চেয়ে দফতরের ভিতরের নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করছেন বেশি। বাইরে থেকে কেবল দেখা যায় অমুক নিয়মটা মানা হচ্ছে না। ভিতরের লোকেরা বোঝে কে নিয়মের এদিক ওদিক করছে কাজটা আরও দ্রুত করার জন্য, আর কে তা করছে নিজের পকেট ভরার জন্য। কী করে সেচের কাজ ঠিক সময়ে হবে, পোস্ট অফিস আর একটু ভাল কাজ করবে, তার উত্তর লোকপালের কাছে নেই। বরং যে দক্ষ, সৎ লোকগুলো এ সব কাজ করতে পারতেন তাঁরা দমে যাবেন। লোকপাল কাজে লাগবে সেই রাঘববোয়ালদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে, যাঁরা আইনকে পরোয়া না করেও পার পেয়ে যান।
কেবল ঘুসখোরকে শাস্তি দিয়ে স্বচ্ছ, দক্ষ ও তৎপর প্রশাসনের দাবি পূরণ করা যাবে না। বাড়ির সামনে মরা কুকুর পচছে, পুরসভার কর্মী তুলে নিয়ে যাচ্ছেন না। শিক্ষক মাইনে পাচ্ছেন, ক্লাসে আসছেন না। এগুলোও দুর্নীতি, যা ঘুসের চেয়ে বেশি বিপন্ন করে সাধারণ মানুষকে। প্রাপ্য যথাসময়ে না পেলে যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়। অথচ এ দেশে যা পাওয়ার কথা তা পাওয়া একটা বিরল ঘটনা। একটা বড় কারণ, কোন পরিষেবা কার, কোন সময়ের মধ্যে দেওয়ার কথা, স্পষ্ট করে জানানো হয় না নাগরিকদের।
২০০৭-এ পশ্চিমবঙ্গের রেশন রোষে স্পষ্ট হয়েছিল যে, গ্রাহকদের কত চাল-গম কোন দরে পাওয়ার কথা, ক’দিন খোলা থাকার কথা রেশন দোকান, তা অনেকে জানেন না। ফলে ‘সাপ্লাই আসেনি’ বলে পার পেয়ে যান ডিলাররা, গ্রামবাসী জানেন না কোথা থেকে তার সত্যতা জানা যাবে। তাই কোন ডিলারটা চোর, শুধু সেটা খুঁজে লাভ নেই। বদলাতে হবে ব্যবস্থাটাই।
একটা উপায়, নাগরিকদের কী কী প্রাপ্য, কোন শর্তে, তা স্পষ্ট জানানোর পদ্ধতি তৈরি করা। বহু রাজ্যে তৈরি হয়েছে ‘নাগরিক সনদ’ (সিটিজেন্স চার্টার), নাগরিকদের অধিকারগুলি যেখানে বিশদে বলা হচ্ছে। যেমন, জমির নথির জন্য আবেদন করলে কত দিনের মধ্যে দফতর তা দিতে বাধ্য। এর ফলে সরকারি দফতরগুলোর অদক্ষতা বোঝার একটা মাপকাঠি আসে নাগরিকদের হাতে, তাই চাপ সৃষ্টির ক্ষমতাও বাড়ে। এদেশে সেটা হতে দেন না সরকারি কর্মীরাই। বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে তথ্যগুলি তাঁরা অস্পষ্ট করে রাখেন, আর প্রায়ই বদলান, ফলে ধন্দ তৈরি হয়। মিড-ডে মিল প্রকল্পটি যে অন্য অনেক প্রকল্পের তুলনায় নিয়মিত ও কার্যকর তার একটা কারণ এটার বিষয়ে কোনও ধন্দ নেই। সকলেই জানেন, স্কুল খোলা থাকলেই মিড-ডে মিল পাওয়ার কথা প্রতিটি ছাত্রের, এবং তার দায়িত্ব মাস্টারমশাইদের।
আমজনতার কাছে তথ্য প্রকাশের নিয়মিত ব্যবস্থা থাকলে সেই চাপে দুর্নীতিও কমে আসে। উগান্ডায় কেন্দ্রীয় সরকার প্রচুর অনুদান পাঠাত স্কুলগুলির জন্য, কিন্তু বিতরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় নেতা-আমলারা বেশির ভাগই আত্মসাৎ করতেন। শেষে সরকার কোন স্কুলে কত অনুদান গেছে, খবরের কাগজে ছেপে দিতে লাগল। হাতে হাতে ফল: ’৯৫ সালে স্কুলগুলোয় গড়ে বার্ষিক অনুদানের ২৪ শতাংশ টাকা পৌঁছোত, ২০০১-এ পৌঁছোল ৮০ শতাংশেরও বেশি। এ দেশে যদি নিয়মিত জানানো হত কোন ব্লকে রেশনে কত চাল এসেছে, বা সেচ বা রাস্তা তৈরির খাতে পঞ্চায়েতে কত টাকা এসেছে, তা হলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় করার দরকার হত না। ব্যবস্থার চাপে দুর্নীতি কমত।