যার কেউ নেই, তার আছে রাজনীতি। সরকারি সুবিধে যাতে প্রকৃত চাষি পায়, তার জন্য নেতারা কী করছেন? সিপিএম নেতা অচিন্ত্য মল্লিক, জামালপুরের তৃণমূল নেতা তথা পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ প্রদীপ পাল, দু’জনেই বললেন, পঞ্চায়েতে বীজ, সার এলে পঞ্চায়েত সদস্য মধ্যস্থতা করে মালিকের ভাগের জিনিস কিছুটা পাইয়ে দেন ঠিকা চাষিকে। ‘একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকে,’ বললেন অচিন্ত্যবাবু। সোজা কথায় যার মানে, সরকারি অনুদান আর গরিব চাষির মধ্যের জায়গাটুকু আনুগত্যের পরিসর, অধিকারের নয়।
রাজনীতি অধিকার দিতে পারলে জমির মালিক ঠিকাচাষির সঙ্গে লিখিত চুক্তি করতে বাধ্য হত। নয়তো সমবায় কর্তা, পঞ্চায়েত সদস্যরা লিখে দিতেন, সুশান্ত রুইদাস চাষি। তা দেখিয়ে ঋণ মিলত সমবায় থেকে। কিন্তু এখন সমবায়ের কর্তারাও জমির মালিক। দলের নেতারাও। তারা সুশান্তদের কেউ নয়। অচিন্ত্যবাবু বললেন, ‘ঠিকাচাষি বেশি বিপন্ন। তবে তাদের জন্য আলাদা কোনও কর্মসূচি নয়। সব চাষির জন্য এক আন্দোলন।’ সেটা কী? সরকারকে ফসলের সহায়কমূল্য বাড়াতে হবে, যাতে জমির মালিক চাষে ফের উৎসাহী হয়। তাতে ঠিকাচাষির কী সুবিধে? ‘তাকে পাট্টা পাওয়ার জন্য আন্দোলন করতে হবে।’
আরও দার্শনিক কথা বললেন ভাতারের বিধায়ক বনমালী হাজরা, ‘এই চাষিদের কী হবে, এ হল চিরন্তন প্রশ্ন। মা মাটি মানুষের সরকার এদের জন্য ভাবছে।’ কী ভাবছে? ‘কে কী চাষ করবে, সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তৈলবীজ, ভুট্টা…’ কিন্তু বিকল্প চাষ করেও বা ঠিকাচাষির সুবিধে কোথায়? গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন বনমালীবাবু। তাঁর নিজের সাতটি ধানের মরাই, তিনটি পুকুর, ৬০ বিঘে জমি, পাঁজা করে রাখা সারের বস্তা, কোথাও উত্তর মিলল না।
ঠিকাচাষিদের পাশে যে রাজনৈতিক দল নেই, তা স্পষ্ট করে দিলেন জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন। বললেন, ‘বহু দাবি নিয়ে লোকে ডেপুটেশন দিতে আসে। ‘ওরাল লেসি’-দের দাবি নিয়ে কেউ আসে না। ওঁরা সংগঠিত নন। কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনও আছে বলে চোখে পড়ছে না।’
যে বাজার ধরতে পারে না, নেতাও ধরতে পারে না, তার মরা ছাড়া গতি কী?
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১ ও ২ সেপ্টেম্বর ২০১৫
কী পাওয়ার কথা, কত দিনে, কত মঞ্জুর হল
দুর্নীতি-বিরোধী সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা মহারাষ্ট্রের অণ্ণা হাজারে লোকপাল বিলের দাবিতে দিল্লিতে অনশনে বসেন ৫-৯ এপ্রিল, ২০১১। বহু মানুষ তাঁর আন্দোলনে সামিল হন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে লোকপাল বিল পাশ করে সংসদ।
যে দেশে সাধারণ মানুষের ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারকে, সেই দেশ প্রজাতন্ত্র। গণতান্ত্রিক দেশে সেই ইচ্ছার প্রকাশ ও রূপায়ণ জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে দিয়ে হয়ে থাকে। ক্ষোভ দেখা দেয় যখন জনপ্রতিনিধিরা সেই ইচ্ছার মর্যাদা দেন না। যেখানে গরিব ঘুস দিতে বাধ্য হয়, নেতা-আমলারা বিপুল সম্পদ আত্মসাৎ করে, তেমন দেশকে ‘আমার দেশ’ বলে মেনে নেব কেন? সেই রাগেই লক্ষাধিক ভারতবাসী এক স্বল্প-পরিচিত, সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধের সঙ্গে অনশনে বসলেন, স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হলেন। তাগিদ ছিল তীব্র, প্রকাশও হয়েছে জোরালো। এবার চিন্তার প্রয়োজন মানুষের মূল ইচ্ছাটি নিয়ে। দুর্নীতি দূর হোক, এই যদি হয় দেশের মানুষের চাহিদা, লোকপাল আইন পাশের দাবিই কি তা পূরণের সবচেয়ে কার্যকর উপায়?
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি উত্তরপ্রদেশের বিধায়কদের বিষয়ে নানা তথ্য সংগ্রহ করা হয়। দেখা গিয়েছিল, যাঁদের ‘রাজনীতিতে প্রবেশের পর নিজের বা পরিবারের আর্থিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে,’ তাঁরা প্রায় ৪০ শতাংশ। ‘রাজনীতিতে প্রবেশের পর নতুন ব্যবসা কিংবা ঠিকাদারির কাজ শুরু হয়েছে বা বেড়েছে’ ৫৪ শতাংশের ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করেছেন অন্তত ৪২ শতাংশ। সংখ্যাগুলি খানিকটা অনুমান-ভিত্তিক, তবু এ-ও ঠিক যে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ভারতে দুর্নীতি দ্রুত বেড়েছে। লোকপাল আইন হলে বহু সাংসদ বেকায়দায় পড়বেন। জেলের টিকিট কে-ই বা কাটতে চায়?
এই সাংসদদের খুব বেশি দোষও দেওয়া চলে না। সবাই জানে, ভোটে লড়তে যে বিপুল টাকা লাগে তার কোনও বৈধ উৎস অধিকাংশ প্রার্থীই দেখাতে পারবেন না। ভোটের আগে প্রকাশ্যে টাকা বিলি হয় বহু রাজ্যের নির্বাচনে। টাকাগুলো আসে কোথা থেকে? যে-কোনও সাংসদ ধরেই নেন, তাঁর দল আইনের বাইরে গিয়েও তাঁর জন্য টাকা তুলবে। আর নির্বাচনের জন্য যখন টাকা তুলতেই হচ্ছে, তখন যারা টাকা তুলছে তারা যে কিছু টাকা নিজের পকেটে পুরবে, তাতে কি আশ্চর্য হওয়া চলে? সাংসদ নিজে সৎ হলেও তাঁকে পার্টির তোলা টাকার উপর নির্ভর করতেই হবে। তাই কোন সাংসদ সৎ আর কে অসৎ, বিচার করে লাভ হয় না। সাংসদ নির্বাচনের যে-ব্যবস্থা বহাল, সেটাই দুর্নীতিকে অবধারিত করে তোলে।
নির্বাচনে দুর্নীতি রোধ করা যায় কী করে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড় বড় কর্পোরেটগুলো রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনী খরচ দেয়। সেখানে সুপ্রিম কোর্ট যেমন রায় দিয়েছে, তাতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, যে-কোনও কোম্পানি তার পছন্দের দলকে যত ইচ্ছে টাকা দিতে পারে, যদি তারা তা খোলাখুলি ঘোষণা করে দেয়। ভারতে (বা ফ্রান্স-জার্মানিতে) ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হবে, একে পয়সা দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো বলেই ধরে নেবেন অনেকে। কেউ হয়তো বলবেন, দল যখন টাকা নেবেই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে, তখন লুকোছাপা না করে খোলাখুলি বলতে দোষ কী? অন্য পক্ষ আপত্তি করবেন, কে কাকে কত দিচ্ছে, সে-তথ্য এত জটিল যে তা জানিয়ে দিলেও হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তের পক্ষে তার তাৎপর্য উদ্ধার কঠিন।