এ যে গল্পের গোরু নয়, মালুম হল সত্যি গোরু দেখে। টেল আভিভ থেকে মিনিট চল্লিশের দূরত্বে এক ডেয়ারি ফার্মে দুগ্ধবতী গাভী, বাছুর নিয়ে দু’হাজার প্রাণী। দেখাশোনা করেন ২০ জন। দিনে এক একটা গোরু দুধ দেয় ৭২ কিলোগ্রাম অবধি, গড়ে ৪১ কিলোগ্রাম। গোরু-পিছু দুধ উৎপাদনে বিশ্বে সেরা ইজরায়েল। দুধ (মেশিনে) দোওয়ার পর তা পাইপে যাওয়ার আগে একটি যন্ত্র বিশ্লেষণ করে বলে দেয়, কতটা ল্যাকটোজ, ফ্যাট, প্রোটিন, ইউরিয়া আছে তাতে। সংক্রমণের ফলে দুধে রক্ত এলে আপনিই বন্ধ হয়ে যাবে দোওয়ার যন্ত্র। বারোশো গাভীর প্রতিটির সামনের ডান পায়ে লাগানো ‘মনিটর’ থেকে অন্তত ১০০টি ডেটা নিরন্তর বলে দিচ্ছে, কোন গোরু কেমন আছে, কার কী চিকিৎসা, পরিচর্যা দরকার। কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই আহ্লাদি ভঙ্গিতে ভিজে নাক বাড়িয়ে দেয় সাদা-কালো ইজরায়েলি হলস্টেইন। নাকে হাত রেখে মনে হয়, কেন ভারতে এমন হয় না?
সমস্যাটা ঠিক প্রযুক্তির নয়। কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তিতে ভারত কম যায় না, তার প্রমাণ সবুজ বিপ্লব। তফাত মনে হয় এখানেই যে, ও দেশে ল্যাবরেটরির কাজ থেকে চাষির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা না-পড়া পর্যন্ত ‘চাষ’ নামক কাজটি চলতে থাকে। আর এখানে বিজ্ঞানী চাকরি করেন, ফড়ে ব্যবসা করেন, চাষ করেন কেবল চাষি। চাষির ক্ষতি হলেও ব্যবসায়ীর লাভ, আর বিজ্ঞানীরা ফসলের বাজারদর জানেনই না। চাষ করে লাভ হল কি না, সে-প্রশ্নে ও দেশে সবাই তটস্থ। এ দেশে লাভ-ক্ষতি চাষির ভাগ্যের ব্যাপার।
চাষিও তা-ই বিশ্বাস করেন। তাই লাভ অনিশ্চিত জেনেও আড়াই-তিন বিঘে জমি চাষ করেন তিনি, তবু সমবায় তৈরি করে অনেকের জমি একসঙ্গে চাষ করে খরচ কমিয়ে লাভ বাড়ানোর চেষ্টা করেন না। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির কোনওটাই ছোট চাষির জন্য নয়, জেনেও জোট বাঁধতে পারেন না। স্বনির্ভর হওয়ার চাইতে সরকার-নির্ভর হওয়া তাঁদের নিরাপদ মনে হয়।
সরকারও তাই চায়। এ দেশে চাষি আর বাজারের মাঝখানে সরকার। কম সুদে ঋণ, ভর্তুকিতে (কিংবা বিনামূল্যে) জল, বিদ্যুৎ, সার। শেষ অবধি ন্যূনতম মূল্যে খরিদ। ও দেশে চাষির সামনে বাজার, পিছনে সরকার। ইজরায়েলের চাষি জল, বিদ্যুৎ সব কেনেন বাজারদরে। ভর্তুকির কোনও ধারণাই চালু নেই। কৃষিমন্ত্রী ইয়ায়ের শমির বললেন, ‘প্রাইভেট সেক্টর যাতে সারা বিশ্বে বাজার ধরতে পারে, তার জন্য সহায়তা করে সরকার।’ এ দেশে সরকার প্রতিযোগিতা থেকে আড়াল করে চাষিকে, ও দেশে প্রতিযোগিতায় জেতাতে চাষিকে পিছন থেকে ঠেলে সরকার। এমনকী ক্রেতার স্বার্থেও চাষিকে দাম কমাতে বলে না ইজ়রায়েল। ইজ়রায়েলে উৎপন্ন ফসলের দাম সে দেশের চাইতে জার্মানিতে বেশ খানিকটা কম কেন, ক’দিন আগে তা নিয়ে খানিক বিক্ষোভও হয়ে গিয়েছে টেল আভিভে। দাম অবশ্য কমেনি।
কৃষি না শিল্প, আমাদের এই নিয়ে বিতর্ক। ইজরায়েলে প্রশ্নটাই অর্থহীন। লাভজনক কৃষি আসলে শিল্পই। দুটোর উৎপাদন, বিপণন হতে হবে এক নীতিতে। এ কথাটা হজম না করে কেবল মেশিন, প্রযুক্তি আনলে জল হয়তো একটু বাঁচবে, চাষি বাঁচবে না।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ মে ২০১৫
আত্মঘাতী চাষির খোঁজে
২০১৫ সালের জুলাই-অগস্ট মাসে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ১৩ লক্ষ হেক্টর কৃষিজমি।
শেষ শ্রাবণের বর্ধমান। চাষিকে পথে বসিয়ে এখন রূপ দেখাচ্ছে বেহায়া আকাশ। ফাঁপানো মেঘ, গিল্টি-করা রোদ, ফিচেল বৃষ্টি। উপরমহলে যখন এমন নির্লজ্জ উৎসব, নীচে তখন ঢিবি-ভাঙা পিঁপড়ের মতো চাষিদের ছোটাছুটি। পুরুষ মেয়েরা মাথায় করে, ভ্যানরিকশা করে ধানের চারার বান্ডিল বয়ে এনে ফের পুঁতছেন জমিতে। পলিথিনের নীচে আবার তৈরি করছেন সবজির চারা। বাড়তি খরচ, বাড়তি পরিশ্রমেও অনেক দেরিতে, অনেক কম পরিমাণ ফসল মিলবে। তবু মাথায়-পিঠে বৃষ্টি নিয়ে চারদিকে বাঁচার মরিয়া চেষ্টা। তার মাঝে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করতে হল, চাষি মরে কেন?
উত্তরের খোঁজ শুরু করা চলে হরগোবিন্দপুরে, যেখানে সুশান্ত রুইদাসের বাড়ি। জামালপুর ব্লকের সহ-কৃষি অধিকর্তা জানালেন, সুশান্ত রুইদাস মদ খেতেন বলে ছেলেদের সঙ্গে অশান্তি লেগেই থাকত। এক দিন মা বাড়ি ছিল না, সেই সুযোগে ফুচকা-বিক্রেতা ছেলেরা বাপকে পেটায়। অভিমানে আত্মহত্যা করেন জামালপুর ব্লকের হরগোবিন্দপুরের বছর পঁয়তাল্লিশের সুশান্ত। নিজে গ্রামে গিয়ে ও স্থানীয় সূত্রে খবর পেয়ে এমনই তিনি লিখেছেন রিপোর্টে।
সুশান্তের স্ত্রী পূর্ণিমা তাঁদের ইট-গাঁথা দেওয়াল, টিনের চালের বাড়ির দাওয়ায় বসে বলছিলেন, পটল খেতে জল জমেছে দেখেই মুষড়ে পড়েছিল লোকটা। অনেক ধার হয়েছিল কিনা। কত ধার, প্রশ্ন করতেই গুটিয়ে গেলেন পূর্ণিমা। ঘিরে-থাকা প্রতিবেশীরা বলতে লাগলেন, ‘না না, ও সব ওরা কিছুই জানে না।’
যার কাছে তাঁর ধার, সেই তারক সাহানা ছিপছিপে যুবক, প্রায় ৪৭ বিঘা জমির মালিক। নিজে চাষ করেন ২০ বিঘে, বাকিটা ঠিকায় দিয়েছেন আট জন চাষিকে। তাঁদেরই এক জন সুশান্ত রুইদাস। এক মরশুম থেকে অন্য মরশুম, এক বছরের জন্য জমি নিয়েছিলেন। শীতে আলু মার খেয়েছে। বর্ষায় ১০ কাঠা জমিতে বাদাম, ১০-১৫ কাঠা জমিতে পটল বসিয়েছিলেন। বাদাম বীজ, পটলের কীটনাশক, লেবার খরচ, সবই ধারে। কেবল তারকের কাছেই ১৫ হাজার টাকার বেশি দেনা সুশান্তর, সব মিলিয়ে তার ডবল তো হবেই। টানা বৃষ্টিতে বাদামের কল বেরিয়ে গিয়েছে, অর্ধেক খেত থেকে তোলাই যায়নি। পচেছে পটল। ঠিকা চাষিদের ঢ্যাঁড়শ, লঙ্কা সব নষ্ট হয়েছে, বললেন তারক।