রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরও রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনার পরিসংখ্যানের প্রাথমিক বিশ্লেষণ করেছে। দেখা যাচ্ছে, অস্ত্রোপচারই নব্বই শতাংশ, জরায়ু বাদ দেওয়ার সংখ্যা অত্যধিক, যে সব ভাঙা হাড় প্লাস্টার করলে সেরে যেত তারও অস্ত্রোপচার হচ্ছে। ‘ইঙ্গিত উদ্বেগজনক,’ বলেন দফতরের এক কর্তা।
এত অস্ত্রোপচার কেন? মেদিনীপুর শহরের ২০ শয্যার একটি নার্সিংহোমের মালিকের উত্তর, ‘আমাদের বেড অল্প, ইমার্জেন্সি নেই। জ্বরজারি কেস ভর্তি করা যায় না।’ উলুবেড়িয়ার একটি হাসপাতালের মালিক অবশ্য আরও সোজাসাপটা, ‘ম্যালেরিয়া, ডায়েরিয়ার জন্য বিমা কোম্পানি যা টাকা দেয়, তাতে ওষুধের দাম উঠবে না। তার ওপর টিপিএ বারবার প্রশ্ন করবে, কেন ভর্তি করলেন? আউটডোরেই চিকিৎসা করলেন না কেন?’ পেট খারাপ, জ্বরের জন্য হাসপাতালের পাওনা স্রেফ বেড চার্জ। পড়তায় পোষায় না।
ওই দুই হাসপাতালেই জরায়ু বাদ দেওয়া স্বাস্থ্যবিমার কার্ডে একটি প্রধান অস্ত্রোপচার। মেদিনীপুরের ডাক্তারবাবুর বক্তব্য, বিমা কোম্পানি তো ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট দেখেই অনুমতি দিচ্ছে, তা হলে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের অভিযোগ ওঠে কী করে? হাওড়ার ডাক্তারবাবু অবশ্য স্পষ্টই বলে দিলেন, অতিরিক্ত ঋতুস্রাব বা শ্বেতস্রাবের চিকিৎসা অন্য ভাবেও করা যায়। তবে অনেক সময়ে রোগীর তরফ থেকেও ‘ঝামেলা শেষ’ করার চাপ থাকে। সে ক্ষেত্রে ঝুঁকিগুলির বিষয়ে না বোঝালে জরায়ু অপ্রয়োজনেও বাদ যেতে পারে।
তার পরিমাণ কত? শিউরে ওঠার মতো কথা বললেন কলকাতার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়। ‘কান্দির এক ডাক্তার সেদিন বড়াই করে বললেন, এক মাসে ৪৫টা জরায়ু বাদ দিয়েছেন। এটা কী করে সম্ভব? এক জন ডাক্তার সাধারণত তাঁর গোটা ডাক্তারি জীবনে ৪৫টা হিস্টরেকটমি করে উঠতে পারেন না,’ বললেন এই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ডাক্তার।
একে ‘বাড়াবাড়ি’ বলে উড়িয়ে দেওয়া গেলে ভাল হত। কিন্তু অন্য রাজ্যে এমন ইতিমধ্যেই ঘটেছে। ২০১১ থেকে ২০১৩ সালে বিহারের সমস্তিপুরে স্বাস্থ্যবিমার অধীনে মোট ১৪,৮৫১ কেসের মধ্যে ৫৫০৩ ছিল জরায়ু বাদ দেওয়া।
রাজস্থানের দাউসা জেলা থেকেও অত্যধিক হিস্টরেকটমির নালিশ আসে। পেট ব্যথা, ঋতুচক্রে গোলমাল, যে-কোনও সমস্যা নিয়ে গেলেই জরায়ু বাদ দেওয়া হচ্ছে এটা প্রকাশ পেলে ২০১৩ সালের জুনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দুই জেলাশাসকের রিপোর্ট তলব করে। এ রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী দু’জনেই মহিলা। বিষয়টি নজর করছেন কি?
তার মানে এই নয় যে, স্বাস্থ্যবিমা গরিবের কোনও কাজে লাগে না। বীরভূমের সমীক্ষা বলছে, বিমার স্মার্টকার্ড ব্যবহার করলে গরিবকে সত্যিই পকেট থেকে খরচ করতে হচ্ছে কম, গড়ে ৩৬৩৪ টাকা কম। এটা সামান্য কথা নয়। একটি হিসেব বলছে, অতি-দরিদ্র মানুষদের এক মাসে রোজগার যত টাকা, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে গড় খরচ তার দশ গুণ, বেসরকারিতে পঁচিশ গুণ। ঋণে ডুবে যাওয়া এড়াতে গরিবরা এত দিন হাসপাতাল এড়িয়ে চলে যে, তার পর আর ডাক্তারের বিশেষ কিছু করার থাকে না। প্রাণে মরা, নইলে ভাতে মরা, এই দুই থেকে গরিবকে নিষ্কৃতি দিতে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনা শুরু হয়েছিল। এ রাজ্যের বিপিএল জনসংখ্যার প্রায় ষাট শতাংশ ইতিমধ্যেই এই বিমার আওতায় এসেছে। এখনও অবধি সাড়ে আট লক্ষেরও বেশি ‘কেস’ হয়েছে বিমার স্মার্টকার্ডে। নিঃসন্দেহে এমন অনেক অস্ত্রোপচার এর মধ্যে রয়েছে, যা বিমা না থাকলে করাতেন না গরিব মানুষ। ব্যথার ওষুধ বা নানা টোটকা-মাদুলির ভরসায়, কর্মক্ষমতা হারিয়ে, কোনও মতে বেঁচে থাকতেন।
অথচ যে ভাবে বিমার রূপায়ণ হচ্ছে তাতে বেশ কিছু ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। এক, স্বাস্থ্য দফতর থেকে স্বাস্থ্যবিমার প্রচুর তথ্য নিয়মিত ওয়েবসাইটে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সে সবই হল ক’জন কার্ড পেল ক’জন ভর্তি হল, কত টাকা ক্লেম করে কত পেল, তার হিসেব। রোগীরা কী কী কারণে ভর্তি হচ্ছেন, কী চিকিৎসা পাচ্ছেন, তা জানার উপায় নেই। তাই অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার আড়ালে থেকে যাচ্ছে।
দুই, গরিব জেলাগুলোতে নার্সিংহোম কম। যেমন, বর্ধমানে গরিবের স্বাস্থ্যবিমার নেটওয়ার্কে রয়েছে ৬৬টি হাসপাতাল, বাঁকুড়ায় ৩১ আর পুরুলিয়ায় ৯। এ থেকেই বোঝা যায় যে স্বাস্থ্যবিমা দিয়ে গরিবকে চিকিৎসার সুযোগ করে দেওয়ার বিপদ কোথায়। যে জেলা যত গরিব, বিমা কাজে লাগানোর সম্ভাবনা তার তত কম।
তিন, বিপুল অপচয় হচ্ছে। গরিবকে চিকিৎসা পাইয়ে দেওয়ার প্রকল্প কার্যত হয়ে দাঁড়িয়েছে নার্সিংহোমকে টাকা পাইয়ে দেওয়ার প্রকল্প। ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতাল, আর তা থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে ঝাড়গ্রাম নার্সিংহোম, দুটোই স্বাস্থ্যবিমার আওতায়। সরকারি সূত্রে খবর, চলতি অর্থবর্ষে হাসপাতাল ১৬টি কেস করে বিমা কোম্পানি থেকে পেয়েছে ৪০,৯১২ টাকা (গড়ে ২৫৫৭ টাকা); ঝাড়গ্রাম নার্সিংহোম করেছে ৪৯৫টি কেস, পেয়েছে প্রায় ২৫,১৪,০০০ টাকা (গড়ে ৫০৭৮ টাকা)। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার আক্ষেপ, জেলায় জেলায় সরকারি হাসপাতালে ভর্তি-হওয়া রোগীকে পাশের নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে অস্ত্রোপচার করছেন সরকারি ডাক্তার। স্বাস্থ্যবিমা আছে, রোগীর চিন্তা কী? প্রাণে যদি বা বাঁচে, ঠকে মরবেই গরিব।