এ কেবল স্বাস্থ্যের ছবি নয়। স্কুলশিক্ষাতেও ছবিটা কাছাকাছি। সম্প্রতি এ নিয়ে প্রকাশিত ‘অসর ২০১৪’ সমীক্ষায় প্রকাশ, এ রাজ্যে সরকারি স্কুলের প্রাথমিকে অর্ধেকেরও বেশি পড়ুয়া, উচ্চ প্রাথমিকে ৭৬ শতাংশ পড়ুয়া প্রাইভেট টিউশন নিচ্ছে। সেখানে তামিলনাড়ুতে দেখা যাচ্ছে, সরকারি স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে টিউশন নেওয়ার অনুপাত ৬-৭ শতাংশ। এবং, এ রাজ্যে টিউশন ফি সে-রাজ্যের চাইতে বেশি। খরচ বেশি করে বাড়তি লাভ কী হচ্ছে? মাতৃভাষায় রিডিং পড়তে পারার ক্ষেত্রে গ্রামের পড়ুয়ারা এ রাজ্যে একটু এগিয়ে, কিন্তু অঙ্কে ওরা গোড়ায় পিছিয়ে থাকলেও পরে এগিয়ে যাচ্ছে। ইংরেজিতে আবার আগাগোড়াই ওরা এগিয়ে। সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, ইস্কুলে আমাদের পড়ুয়ারা যাচ্ছেই কম। সমীক্ষার দিন মাত্র ৫৬ শতাংশ পড়ুয়াকে ক্লাসে দেখা গিয়েছে। তামিলনাড়ুতে ক্লাসে ছিল ৮৭-৮৯ শতাংশ পড়ুয়া। এ থেকে ইঙ্গিত মেলে, যে-কোনও কারণেই হোক, এ রাজ্যে শিক্ষকদের কাছে ক্লাসে না-পড়ানোর সুবিধেটা বড় হয়ে উঠছে। ছাত্রের কাছেও টিউশনে গিয়ে পড়া বোঝা বেশি সুবিধেজনক মনে হচ্ছে।
এর ফলে অসুবিধেয় পড়ছে গরিব। যে-সম্পদ গরিবের জন্য বরাদ্দ, সে ওষুধপত্রই হোক আর মানবসম্পদ (শিক্ষক, ডাক্তার) হোক, গরিব তা পাচ্ছে না, কিংবা সামান্যই পাচ্ছে। কিন্তু গরিবের না-পাওয়া, আর তার ফলে সরকারের অপচয়ের হিসেবটা কষার চাড় নেই কারও। নেতারা আরও ফ্রি পণ্য, ফ্রি পরিষেবা ঘোষণা করতে চান। বিরোধীরা চেঁচান, অত দেবে বলেছিলে, দিলে মোটে এত! মিডিয়া খোঁজে, অত দিতে গিয়ে কত কার পকেটে গেল। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত গরিবকে ফ্রি পরিষেবা দেওয়ার চাকরির বিজ্ঞাপন খোঁজে। অনাদীশ বাগদিদের কী হল, কতটুকু পেল তারা, খোঁজ করতে ভুল হয়ে যায়।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
এখানে সস্তায় জরায়ু বাদ দেওয়া হয়
গরিবের জন্য খরচ হচ্ছে অঢেল। কিন্তু সে-টাকা গরিবের কাজে লাগছে কি? প্রশ্নটা ফের উসকে দিচ্ছে গরিবের স্বাস্থ্যবিমা। গরিব যাতে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত না হয়, তার জন্য বছর বছর স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়াম (পাঁচ জনের পরিবার-পিছু ৭৫০ টাকা) মেটাচ্ছে সরকার। বছর সাতেক আগে ‘রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনা’ শুরু হওয়ায় এখন সরকারি বা বেসরকারি, যে-কোনও হাসপাতালে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা বিনা খরচে করাতে পারে গরিবরা। কিন্তু বিমার সুবিধে নিয়ে হাসপাতালে যেসব চিকিৎসা হচ্ছে, তার নকশাটা সন্দেহজনক। অ্যাপেনডিক্স, গল-ব্লাডার, ছানি কাটার যত কেস দেখা যাচ্ছে, তার তুলনায় ম্যালেরিয়া বা ডায়েরিয়া অনেক কম। রোগীর চাহিদার চেনা নকশার সঙ্গে স্বাস্থ্যবিমায় চিকিৎসা জোগানের নকশার কোনও মিল পাওয়া যাচ্ছে না।
এমনই ছবি উঠে এসেছে বীরভূম থেকে, পরপর দু’বছরের তথ্য তুলনা করে। ২০১২ সালে চারটি ব্লকে বারো হাজারেরও বেশি বাড়িতে সমীক্ষা করে দেখা হয়েছিল, কতজন কী কী কারণে গত এক বছরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তার পরের বছর (২০১৩) ওই বাড়িগুলির মধ্যেই ১৫০টিতে গিয়ে ফের দেখা হয়েছিল, রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনা যাঁদের রয়েছে, তাঁরা কী কী কারণে ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। এই দুইয়ের নকশায় বিস্তর ফারাক উঠে আসে। সেই নকশা সম্প্রতি তুলে ধরলেন দুই গবেষক, দিল্লির ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট-এর সুমিত মজুমদার এবং পশ্চিমবঙ্গের সোসাইটি ফর হেলথ অ্যান্ড ডেমোগ্র্যাফিক সার্ভেইলন্স-এর অনমিত্র বারিক। ‘জনস্বাস্থ্য এবং সরকারি নীতি’ নিয়ে ‘ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা’-য় (আইডিএসকে) দু’দিনের আলোচনায় তাঁরা পেশ করেন এই গবেষণা।
কী দেখছেন গবেষকরা? স্বাস্থ্যবিমার কার্ডে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, এমন চারশোরও বেশি রোগীর বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখছেন, নব্বই শতাংশ রোগীই ভর্তি হয়েছেন অস্ত্রোপচারের জন্য। অস্ত্রোপচারগুলির মধ্যে প্রধান হল ছানি কাটা, আর তারপরেই মেয়েদের জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া (হিস্টরেকটমি)। আরও চিন্তার বিষয়, যে সাতান্ন জন মহিলার জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের আঠারো জনেরই (৩১ শতাংশ) বয়স চল্লিশের নীচে। ডাক্তাররা পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত সহজে জরায়ু কেটে বাদ দিতে চান না। ছানি কাটার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, দশ জনে এক জনের বয়স পঞ্চাশের নীচে। অন্য যে প্রধান অস্ত্রোপচার, সেগুলো যথাক্রমে গল-ব্লাডার বাদ দেওয়া, হার্নিয়া-হাইড্রোসিল, অর্শ এবং অ্যাপেনডিক্স। প্রসঙ্গত, জরায়ু, অ্যাপেনডিক্স, আর গল-ব্লাডার, এই প্রত্যঙ্গগুলিকে ‘বাদযোগ্য’ বলা হয় চিকিৎসাশাস্ত্রে। অর্থাৎ এগুলোকে বাদ দিলে স্বাস্থ্যের খুব বড় ক্ষতি কিছু হয় না। গরিবের স্বাস্থ্যবিমা আসায় এই তিনটিকেই বাদ দেওয়া জরুরি হয়ে উঠছে।
অথচ খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না আগের রোগগুলোর। ২০১২ সালে যে সব অসুস্থতার কারণে লোকে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তার মধ্যে প্রধান ছিল জ্বর, টাইফয়েড, পেটের অসুখ, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া। কেবল বীরভূমের সমীক্ষাতেই নয়, গোটা দেশেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রধান কারণ নানা ধরনের সংক্রমণ, শ্বাসকষ্ট, রক্তসঞ্চালনে সমস্যা, দুর্ঘটনা বা হিংসাজনিত আঘাত। নানা বছরের জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ফল থেকে এই তথ্য উঠে এসেছে। কিন্তু বিমার স্মার্টকার্ডে এগুলোর প্রায় দেখাই মিলছে না। ‘তার মানে, এগুলোর জন্য ভরসা সেই সরকারি হাসপাতালের, নইলে হাতুড়ের,’ বলছেন সুমিতবাবু।