ইস্টারলি নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কয়েক কিলোমিটার দূরে নিউ ইয়র্ক শহরেই রয়েছে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানকার অর্থনীতির অধ্যাপক জেফ্রি সাকসের তাত্ত্বিক অবস্থান কিন্তু ইস্টারলির থেকে হাজার মাইল দূরে। ইস্টারলির বক্তব্যের অনেকটাই বস্তুত জেফ্রি সাকসের তত্ত্বের বিরোধিতা।
সাকসের মতে, দারিদ্র ঘোচাতে হলে বাইরে থেকে আর্থিক অনুদান দেওয়া নেহাতই আবশ্যক। মন্দ আর্থিক দশার জন্যই গরিব দেশের প্রশাসন এত মন্দ। গরিব দেশে মানুষের শিক্ষা কম, সামাজিক সংগঠনগুলো দুর্বল। ফলে যে টাকায় গরিবের উন্নয়ন হতে পারত, তা নষ্ট হয় দুর্নীতিতে। দারিদ্র থেকে দুর্নীতি, আর দুর্নীতি থেকে দারিদ্রের একটা দুষ্টচক্র চলে। ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’ সংস্থা দুর্নীতির নিরিখে সব দেশের যে তালিকা তৈরি করেছে, তাতে গরিব দেশগুলিই যে নীচের দিকে থাকে (সব শেষে বাংলাদেশ আর আফ্রিকার চ্যাড) সেটা কাকতালীয় নয়। যেখানে মানুষের টাকা কম, সেখানে তাদের শিক্ষা কম, মিডিয়া কমজোরি, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন দুর্বল। ফলে সরকারের উপর নজরদারির ক্ষমতা কম। তাই সে সব দেশে দুর্নীতি হচ্ছে বেশি। তাঁর প্রস্তাব, গরিব দেশকে ধনী দেশ টাকা দিক দারিদ্র কমাতে। টাকা আসুক একেবারে নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য, যেমন ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ, বেশি খাবার উৎপাদন, বিশুদ্ধ পানীয় জল, শৌচ ও নিকাশির উন্নতি। তার সুবিধে, কাজ হচ্ছে কিনা তা সহজেই নজর করা যাবে। এমন নানা প্রকল্পকে কাজে লাগিয়ে গরিবের জীবনের মানে উন্নতি হলে দেশের নাগরিক সমাজ শক্তিশালী হবে। সরকারের উপর তার নিয়ন্ত্রণ, নজরদারি বাড়বে। সরকারের পক্ষেও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা সহজ হবে। দুর্নীতিও কমবে, দারিদ্রও কমবে।
এমন ভাবে এক একজন এক-একটা পদ্ধতির কথা বলেছেন। কিন্তু এঁরা সকলেই ‘আমূল সংস্কার’ চান। রাজনৈতিক অভ্যুত্থান থেকে অর্থনৈতিক বিধিব্যবস্থার মোড় ঘোরানো, যুক্তির দিক থেকে কোনওটাই মন্দ নয়। কিন্তু একটু ভাবলে স্পষ্ট হয়, এর সবগুলোই খুড়োর কল। সার্বিক পরিবর্তনের লক্ষ্য সামনে রেখে হেঁটেই যেতে হবে। তার নাগাল পাওয়া যাবে কবে তা কেউ জানে না। ফরাসি বিপ্লবের মতো আর একটা বিপ্লব আবার কবে হবে, কে বলতে পারে? যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন চালাচ্ছেন, তাঁরাও বলতে পারবেন না কখন তা সামগ্রিক বিপ্লবে পরিণত হবে। বলশেভিক বিপ্লব তার ইঙ্গিত দেয়। কমিউনিস্ট বিপ্লব হওয়ার কথা ছিল এমন দেশে যেখানে পুঁজিবাদ চূড়ান্তে পৌঁছে গিয়েছে। গোটা বিশ্বে তা একসঙ্গে হবে, মার্ক্সের তত্ত্ব অনুসারে এমনই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু ১৯২০ সালে তা ঘটল কেবল রাশিয়ায়, যেখানে পুঁজিবাদ সেভাবে কায়েমই হয়নি। বলশেভিকদের জয় যে অপ্রত্যাশিত ছিল, তাঁরা যে তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, একথা লেনিনই লিখে গিয়েছেন। ফলে রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলন কবে সার্বিক বিপ্লবে পরিণত হবে, কবে তা সমাজের সব বিধিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
বড়সড় একটা আন্দোলন যদি বা ঘটে, যদি তা দেশের প্রতিষ্ঠিত বিধিনিয়মকে আঘাতও করে, তা হলেও শেষ অবধি তার ফল কী হবে তা বলা কঠিন। যে উদ্দেশে আন্দোলন শুরু হয়, প্রায়ই দেখা যায় তার উলটোটা হয়। হিটলার নিজেকে ‘সোশ্যালিস্ট’ বলে দাবি করেছিলেন, তাঁর দলের নামও ছিল ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টি।’ গোড়ার দিকে সে দেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীরা তাঁকে সমর্থনও করেছিলেন। প্রধানত শ্রমজীবী মানুষের সমর্থনে ক্ষমতায় আসার পর কমিউনিস্ট এবং সোশ্যালিস্টদের উপর হিটলার যে নির্যাতন চালিয়েছিলেন, তাঁদের যেভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তা কারও অজানা নয়।
বিধিব্যবস্থার খোলনলচে বদলের চেষ্টা কার্যকরী হবে কিনা, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে। বাইরে থেকে ‘হোলসেল’ পরিবর্তন আনার চেষ্টাতে যেমন বিপদ আছে, তেমনই ‘কোনও একদিন ভিতর থেকে বদল আসবে’ বলে কোনও কিছু না করার বিপদও থেকে যাচ্ছে। ইতিহাসের একটা শিক্ষা হল, খারাপ বিধিব্যবস্থা একবার চালু হয়ে গেলে তা আর সহজে নড়ানো যায় না। আইন-বিধি বদলে দিলেও সামাজিক সম্পর্কে, প্রশাসনের কাঠামোয়, রাজনৈতিক রীতিনীতিতে তার রেশ থেকে যায়। যা গরিবের প্রতি বৈষম্য, বঞ্চনাকে জিইয়ে রাখে। প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেমন আফ্রিকার কিছু দেশের কথা বলা হয়েছে আগেই। অন্য দিকে, এমনও দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, খারাপ বিধিব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে ভিতর থেকেই। যেমন ১৮৮০ থেকে ১৯২০, এই সময় জুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিল দুর্নীতির রমরমা। যে সব বড় বড় ব্যবসায়ী তখন দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন, স্টিল, কয়লা, তামাক, তেল, রেল রাস্তা নির্মাণের সেই কারবারিদের তখন বলাই হত ‘ডাকাতে ব্যবসায়ী’ (রবার ব্যারন)। কিন্তু সেই ব্যাপক দুর্নীতি বেশি দিন চলতে পারেনি। কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিকল্পিত প্রচেষ্টায় যে দুর্নীতি কমেছিল, তা কিন্তু নয়। বরং ওই সময়ে অনেকগুলো পরস্পর সম্পর্কহীন পরিবর্তন ঘটেছিল। যেমন ইউরোপ থেকে প্রচুর মানুষ এলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যাঁদের একটা বড় অংশ শিক্ষিত এবং বামপন্থী মানসিকতার লোক। তাঁরা ব্যবসায়ীদের আধিপত্য এবং দুর্নীতিকে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। ওই সময়ে শিক্ষার হারও দ্রুত বেড়েছে। লোকে খবরের কাগজ পড়তে শুরু করল বেশি। খবরের কাগজগুলিও পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হতে পরস্পর প্রতিযোগিতা করে দুর্নীতির খবর ছাপতে শুরু করল। ভিতর থেকেই ক্রমশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করল। তখনও অসৎ উদ্দেশ্যে, অসৎ উপায়ে পরিবর্তন রুখে দেওয়ার চেষ্টা খুব কম লোকে করেনি। কিন্তু পরিবর্তন রুখতে পারেনি। আজও যে কোনও বিধিব্যবস্থাকে বিকৃত, অকেজো, অদক্ষ করে রেখে নিজের কোলে ঝোল টানার মতো লোক কম নেই। তাদের অনেকে মস্ত ক্ষমতাবান, তা-ও সত্যি। কিন্তু একটা দেশ, একটা সমাজের ব্যবস্থা এত বিচিত্র ও বহুমাত্রিক যে তার সম্পূর্ণটা নিয়ন্ত্রণ করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। নানা পরিবর্তন ক্রমাগত ঘটতেই থাকে, এবং কোনও এক সময়ে নানা সু-সংযোগের ফলে তা ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে। প্রাণপণ চেষ্টাতেও তখন পরিবর্তন রোখা যায় না।