অসুখ জটিল বলেই কি খরচ করতে হচ্ছে? তা-ও মনে হয় না। দশ মাসের প্রিয়ম সাহা কোচবিহার জেলা হাসপাতালে ভর্তি হয় ৫ জানুয়ারি, নেহাতই ডায়ারিয়া নিয়ে। দু’দিন ভর্তি থাকে ওই শিশু। স্যালাইন, ওষুধ মিলিয়ে চারশো টাকা খরচ করতে হয়েছে পরিবারকে।
এরা সকলেই দরিদ্র, সকলেই ভর্তি হয়েছিল সরকারি হাসপাতালের ফ্রি বেডে। তবু যে এমন খরচ, সে কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? গবেষণা তা বলছে না। অর্থনীতির শিক্ষক অরিজিতা দত্ত ও দিল্লির এক গবেষণা সংস্থার গবেষক মন্টু বসু তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমবঙ্গে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ কেমন, তা খতিয়ে দেখেছেন। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য থেকে তাঁরা বলছেন, এ রাজ্যে গ্রামের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে রোগীরা ওষুধের জন্য গড়ে খরচ করেন সাড়ে তিনশো টাকা। আর মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য প্রায় ৬০০ টাকা। সেখানে তামিলনাড়ুর গ্রামে ওষুধের গড় খরচ— প্রায় অবিশ্বাস্য— চার টাকারও কম। আর মেডিক্যাল পরীক্ষার খরচ ২২ টাকা ৩৫ পয়সা। এ হিসেবও হল সব রকম সংগতির রোগীর জন্য। কেবল গরিব রোগীর কথা ধরলে (মাসিক ব্যয়ের নিরিখে চারটি ভাগ করলে, ‘গরিব’ হল সবচেয়ে নীচের এক-চতুর্থাংশ) তামিলনাড়ুতে গ্রাম কিংবা শহরে বাস্তবিক ওষুধের জন্য একটি টাকাও খরচ হয় না।
সেখানে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গরিবের ওষুধের খরচ ৩০২ টাকা, আর শহরে ১৯১ টাকা।
তা হলে কি ‘ফ্রি’ কথাটার মানে বুঝতেই পশ্চিমবঙ্গে ভুল হচ্ছে? তামিলনাড়ুতে ফ্রি চিকিৎসা মানে ওষুধ, টেস্ট, রক্ত, স্যালাইন সব ফ্রি, আর এ রাজ্যে ফ্রি চিকিৎসা মানে কেবল বেডটাই ফ্রি, সঙ্গে বড়জোর স্যালাইন আর দু’-চারটে ওষুধ-ইঞ্জেকশন?
এই গবেষণার পরিসংখ্যান অবশ্য কিছু পুরনো, ২০০৪ সালের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা থেকে নেওয়া। তার পরে সরকার চিকিৎসার খরচ কমানোর একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তা হল ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান। অনাদীশ বাগদি তাঁর কিছু ওষুধ সিউড়ি হাসপাতালের ন্যায্যমূল্যের দোকান থেকে কিনেছিলেন। না হলে তাঁর খরচ আরও খানিকটা বেশি হত, সন্দেহ নেই। কিন্তু বিনা পয়সায় হত না, সেটা নিশ্চিত। নানা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে আন্দাজ করা গেল, এখন ফ্রি বেডের রোগীদের জন্য জরায়ু বাদ (হিস্টরেকটমি) দেওয়ার খরচ চার-পাঁচ হাজার টাকা, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত (হেমাচুরিয়া) চিকিৎসার খরচ সাত থেকে দশ হাজার, রেডিয়োথেরাপির কোর্স সম্পূর্ণ করতে লাগে ২৫-৩০ হাজার। এর মধ্যে ওষুধ-ইঞ্জেকশন, ব্যান্ডেজ, স্যালাইন, রক্ত, মেডিক্যাল টেস্টের খরচ আছে, বাড়তি থাকতে পারে আয়ার খরচ, কারণ দু’জন নার্স প্রায়ই দেড়শো রোগীর ওয়ার্ড সামলান। সরকারি কর্তাদের যুক্তি, এ সব চিকিৎসা বাইরে করাতে গেলে পাঁচ-দশগুণ বেশি খরচ হত। সরকারি হাসপাতাল বলেই এত কমে মিলছে। কিন্তু ডিসকাউন্ট মধ্যবিত্তের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে, গরিবের কাছে হবে কেন? তার তো শূন্য খরচে পাওয়ার কথা ছিল। যেমন তামিলনাড়ুর গরিবরা পান। যে উদ্দেশ্যে গরিবের জন্য ভর্তুকি দেওয়া, সে যাতে খরচের ভয়ে চিকিৎসা এড়িয়ে না যায়, চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঋণে ডুবে না যায়, ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্ট দিলেও সে-উদ্দেশ্য ১০০ শতাংশ ব্যর্থ হচ্ছে। মধ্যবিত্তের জন্য যা মন্দের ভাল, গরিবের জন্য তা পুরোই মন্দ।
এই ভুলটা স্পষ্ট হচ্ছে না, কারণ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের খরচের তুলনা করা হচ্ছে। এটা স্পষ্ট হবে যখন এক রাজ্যের সঙ্গে অন্য রাজ্যের সরকারি চিকিৎসার তুলনা করা হবে। কেন এ রাজ্যের হাসপাতালে ভর্তি গরিব রোগীদের ৫৮ শতাংশ ওষুধ পায়, তামিলনাড়ুতে ৯৮ শতাংশ? আমাদের ৫৪ শতাংশ রোগী হাসপাতাল থেকে মেডিক্যাল টেস্ট করান, আর ওদের ৮৮ শতাংশ? অথচ সেই ২০০৪ সালেও তামিলনাড়ুর ৯৭ শতাংশ সরকারি বেড ফ্রি ছিল। এ রাজ্যে তখন ফ্রি বেড মাত্র ৫৮ শতাংশ।
এখন অবশ্য জেলায় সব বেড ফ্রি। গত অক্টোবর মাসে তেমনই ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাতে হাসব, না কাঁদব? অরিজিতা এবং মন্টুর গবেষণা দেখাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে গরিব রোগীদের ৮০ শতাংশই ভর্তি হন সরকারি হাসপাতালে, কিন্তু হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ সুযোগসুবিধের ২২-২৫ শতাংশ জোটে তাঁদের। উচ্চ মধ্যবিত্ত ও ধনী, দুই শ্রেণি মিলে পাচ্ছে ভর্তুকির ৪৪-৪৫ শতাংশ সুযোগ। এই অনুপাত যদি না বদলায়, তা হলে ফ্রি বেড বাড়লে গরিবের চাইতে বিত্তবানের জন্য ঢের বেশি খরচ হবে সরকারের। গরিবের উপকার করতে চাইলে হয়তো ফ্রি বেডের সংখ্যা কমিয়ে, সেই সব বেডের রোগীদের জন্য ওষুধ, টেস্ট-এর ব্যবস্থা বাস্তবিক ফ্রি করা বেশি দরকার ছিল।
এমন গরিব-উপযোগী ব্যবস্থা যে নেওয়া হচ্ছে না, তা কি কেবলই গরিবের শেষ সম্বলটাও কেড়ে নেওয়ার কোনও গভীর ষড়যন্ত্রের জন্য? তা হয়তো নয়। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, গরিবকে সুবিধে না-দেওয়াতে নানা লোকের নানা ছোট ছোট সুবিধে তৈরি হয়ে আছে। যে-দালাল দুশো টাকায় জোগাড় করেন বিপিএল সার্টিফিকেট, যে-কাউন্সিলর, বিধায়ক কলমের আঁচড়ে (বা ফোনের ধমকে) পেয়িং বেডকে ফ্রি করে প্রভাব দেখান, তাঁরা গরিবের মন্দ চান না। ডাক্তারও গরিব-বিদ্বেষী নন। কিন্তু সব বেড ফ্রি হলে তাঁর সুবিধে, এক বিভাগে রোগী উপচে পড়লে সহজেই অন্য বিভাগের বেড নিতে পারবেন। অ-গরিব রোগীর আত্মীয়দের সুবিধে, বেড ফ্রি হলে খরচ কমে, হ্যাপাও কমে। পেয়িং বেড হলে রোগীর তরফে কাউকে সারাক্ষণ হাজির থাকতে হবে, স্লিপ দিলেই ওষুধ, ইঞ্জেকশন, গজ-ব্যান্ডেজ জোগাতে হবে। হাসপাতাল থেকে এগুলো দিয়ে পরে দাম নেওয়ার নিয়ম নেই। তা ছাড়া, ‘সরকারি হাসপাতালে এসেছি, ফ্রি পাব না কেন,’ এই মনোভাবটাও কাজ করে। এত লোকের এত সুবিধের চাপে এমনিতেই পেয়িং বেডের সংখ্যা কমছিল। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, গত বছর জেলা স্তর পর্যন্ত হাসপাতালে পেয়িং বেড ছিল বড়জোর ১০-২৫ শতাংশ। এবার সেটুকুও ফ্রি হয়ে গেল। তাতে ঝামেলা কমল ঠিকই, কিন্তু বেড ফ্রি করার সুবিধে কে পাচ্ছে, কে দেখতে যাচ্ছে?