শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল স্বাস্থ্য ভবনের এক কর্তার কথা। হাসপাতালে প্রসব বাড়ছে অথচ মায়ের মৃত্যু কমছে না কেন, প্রশ্ন করাতে তিনি বলেছিলেন, ‘তাকিয়ে দেখুন কলকাতা থেকে বারাসত যাওয়ার রাস্তাটার দিকে। প্রতি দু-আড়াই কিলোমিটার অন্তর একটা হাসপাতাল, প্রতিটিতে দু’-তিনজন গাইনোকলজিস্ট, এক-দু’জন অ্যানেস্থেটিস্ট। জেনারাল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার না থাকায় এই ডাক্তারদের সব রকম রোগী দেখতে হয়। ফলে কোনও হাসপাতালেই ২৪ ঘণ্টা সিজারিয়ান হয় না।’ এলাকার কোনও একটি হাসপাতালে যথেষ্ট বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রাখা হলে কলকাতায় রেফার করার হাঙ্গামা, বিলম্বের জন্য মৃত্যু এড়ানো যেত না কি?
সে-প্রশ্নটা তোলাই হয় না, কারণ প্রতিটি সাংসদ, বিধায়ক, পুরপিতা তাঁর নিজের এলাকার হাসপাতালে ‘সিজার’ চালু করবেনই করবেন। ওদের আছে, আমাদের নেই কেন, এই হল যুক্তি। স্বাস্থ্য বাজেট পেশ করার দিনে বিধানসভায় সেই একই দৃশ্য দেখা যায়। কেন মহকুমা হাসপাতালে এমআরআই হবে না, কেন কার্ডিয়াক সার্জারি হবে না স্টেট জেনারেল হাসপাতালে, তাই নিয়ে শোরগোল চলে। সব হাসপাতালে সব পরিষেবা চালু করা সম্ভব কি না, করা উচিত কি না, তা নিয়ে চিন্তা করে কে?
গণস্বাস্থ্যের নীতিতে জনমতকে কতটা পাত্তা দেওয়া উচিত, তা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরাও। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সহযোগীরা দেখিয়েছেন, নানা দেশে গরিব মানুষ সাধ্যাতিরিক্ত খরচে চিকিৎসা করান, কিন্তু টিকাকরণ, পরিশোধিত জল খাওয়া কিংবা মশারি টাঙানোর জন্য সামান্য খরচ করেন না। রোগ প্রতিরোধের বরাদ্দ কাজে না লাগিয়ে জনমত যদি ক্রমাগত আরও সস্তায় আরও ভাল চিকিৎসা চায়, সেই দাবিকে কতটা প্রশ্রয় দেওয়া চলে? জিষ্ণু দাশ দেখিয়েছেন, গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এমবিবিএস ডাক্তারের চিকিৎসার মান হাতুড়েদের চিকিৎসার চাইতে উঁচু দরের নয়। আরও, আরও বেশি পাশ-করা ডাক্তারকে গ্রামে পাঠালে গণস্বাস্থ্যের উন্নতি হবে, এই কথা মানলে কেবল অপচয় বাড়বে, অসুখ কমবে না।
এ কথাগুলো নেতারাও বোঝেন, বললেন রুথ। ‘আমার সবচেয়ে বিরক্ত লাগে যখন নেতাদের দেখি একান্তে বলছেন, “আমার পরিবারের জন্য এমন চিকিৎসাই চাই, কিন্তু বাইরে তো আর বলতে পারি না।” কেন পারেন না? কী করলে কম খরচে বেশি রোগী নিরাময় হন, সে-বিষয়ে হাতেকলমে যা জানা গিয়েছে তা সবাইকে বোঝানোর কাজটা তো নেতাদেরই।’ আরও অনেক বড় হাসপাতাল তৈরি করার চাইতে ৯৯৯ ডায়াল করে যে-পরিষেবা পাওয়া যায় তাকে উন্নত করলে, ছোট হাসপাতালগুলোর ইমার্জেন্সি বিভাগকে উন্নত করলে উপকার হবে অনেক বেশি, তা কে বোঝাবে ব্রিটেনের আম-ভোটারকে?
কে-ই বা বোঝাবে বাংলার নাগরিককে? কল্পচক্ষে দেখার চেষ্টা করুন, বিধানসভায় নেতারা তর্ক করছেন, কী করে নবজাতকের মৃত্যু কমানো যায়। মহকুমা কি ব্লক স্তরে নবজাতক ইউনিট তৈরি করে তার যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষিত ডাক্তার-নার্স জোগান দেওয়ার জন্য বিপুল খরচ (গত এপ্রিল মাসে সরকার ১৬১ জন শিশুবিশেষজ্ঞ চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল কেবল সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিটগুলোর জন্য) করাই কি উচিত? নাকি নিচুতলার স্বাস্থ্য কর্মীদের দিয়ে মায়ের অপুষ্টি কমালে শিশুমৃত্যু দ্রুত কমত? না, বহু চিন্তা করেও ২৯৫টা মুখের মধ্যে থেকে একটা মুখ ভাবা গেল না যিনি বলবেন, আমার এলাকার হাসপাতালে এসএনসিইউ খোলার দরকার নেই, ভাল হাসপাতালে পৌঁছনোর রাস্তা আরও ভাল করুন।
নেতারা সব দেশেই সমান। ‘টপ-ডাউন প্ল্যানিং হঠিয়ে রোগীকে বেশি “চয়েস” দেওয়া, চিকিৎসাব্যবস্থার বিকেন্দ্রিকরণ, এই বদলগুলো আনা হচ্ছে এনএইচএস-এ। শুনতে ভাল লাগে, কিন্তু ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর কাছে “চয়েস” বড় কথা নয়। বড় কথা দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত রেফারাল,’ বললেন রুথ। নতুন ব্যবস্থা মানতে না-পেরে চাকরি ছেড়েছেন তিনি।
এ রাজ্যে স্বাস্থ্যকর্তা, ডাক্তার, ফিল্ডকর্মীরা চাকরি ছেড়ে দেন না, তবে গা ছেড়ে দেন। যতই কাজ করো, কাজের কাজ হবে না, তা মনে মনে জেনে নিষ্প্রাণ, নিরর্থক কাজ করে যান। প্রকল্পের উদ্দেশ্য কী ছিল, আর ফল কী হল, তার কোনও মূল্যায়নও হয় না, কারও জবাবদিহিও চাওয়া হয় না। কেউ প্রশ্ন করতে গেলে উলটে ধমক খান— যা বলা হয়েছে করুন, অত জানার কী দরকার? শেষে শিশুমৃত্যু, প্রসূতিমৃত্যু, ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গিতে মৃত্যু নিয়ে ফের প্রবল হইচই হলে নতুন একখানা প্রকল্প ঘোষণা হয়। উপরের চেয়ারে বসানো হয় নতুন লোক। ওতেই ভোট পাওয়া যায়।
কিন্তু নবজাতক, প্রসূতি বা স্ট্রোক-আক্রান্তের প্রাণ বাঁচানো যায় না। সীমিত টাকায় কী করে সেরা ফল দেওয়া যায় সর্বাধিক রোগীকে, সেটা জনমত ঠিক করতে পারে না। নেতা-নেত্রী কিংবা তাঁদের চামচে ডাক্তাররাও নয়। তার জন্য চাই সমীক্ষা-নিষ্কাশিত, পরীক্ষাসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্যনীতি। আর চাই বুকের পাটা। জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও জনস্বার্থে কাজ করে যাওয়ার সাহস।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ জুন ২০১৩
ফ্রি পেতে গেলে কত দিতে হয়?
কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। নইলে অনাদীশ বাগদিকে সাত দিনে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা কেন খরচ করতে হল সরকারি হাসপাতালে? বছর পঁয়ষট্টির এই চাষি বিপিএল কার্ড দেখিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন সিউড়ি জেলা হাসপাতালে, মস্তিষ্কে স্ট্রোক নিয়ে। ১০ জানুয়ারি। অ্যাম্বুল্যান্স না পাওয়ায় ৫০০ টাকায় গাড়ি ভাড়া থেকে শুরু। তার পর স্যালাইন, ওষুধ, ইঞ্জেকশন, খরচ বেড়েই চলেছে। তবু বহু অনুরোধে বর্ধমানে রেফার করা আটকেছেন তাঁর ছেলে। আরও খরচ টানতে পারতেন না তাঁরা। লিভারের অসুখে আক্রান্ত অবনী সিংহের দশা আরও খারাপ। পনেরো দিনে প্রায় ১৪ হাজার টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে তাঁর, ওই সিউড়ি হাসপাতালেই।