কেন গড়পড়তা ছাত্রদের আর একটু বেশি শেখাতে পারছে না বেসরকারি স্কুলগুলো? এর সম্পূর্ণ উত্তর সহজ নয়। তবে আমি যেটুকু যা জানি, তার ভিত্তিতে বলতে পারি, এর অন্তত একটা ব্যাখ্যা খুব সোজা। তা হল, শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, সেই শিক্ষক, অভিভাবক, প্রশাসক, সকলেই বিশ্বাস করেন যে শিক্ষা গড়পড়তা স্কুলের গড়পড়তা পড়ুয়ার জন্য নয়। তাঁদের দৃষ্টিতে স্কুলশিক্ষার উদ্দেশ্য হল সব চাইতে সফল ছাত্রছাত্রীদের সব চাইতে কঠিন পরীক্ষার জন্য তৈরি করা, যাতে তারা তাদের পরম অভীষ্ট— সরকারি চাকরি, কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে আসন— লাভ করতে পারে। বাদবাকি পড়ুয়ারা যে খরচের খাতায়, সে এক রকম ধরেই নেওয়া হয়।
তাই স্কুল সরকারি হোক বা বেসরকারি, শিক্ষক তাঁর ক্লাসের অধিকাংশ মুখের দিকে তাকানোর সুযোগ পান না। তিনি জানেন, পড়ুয়াদের একটা বড় অংশ লিখতে-পড়তে না শেখা সত্ত্বেও বিজ্ঞান কিংবা ইতিহাসের ক্লাসে বসে থাকছে। কিন্তু তাদের কথা ভাবার সময় তাঁর নেই। তাঁকে পড়িমরি করে সিলেবাস শেষ করতে হবে, যাতে যে ক’জন পড়ুয়া এগোতে পারছে তারা নিশ্চিতভাবে সাফল্যের চৌকাঠে পা রাখতে পারে। অভিভাবকরা শিক্ষকের কাছে সেটাই প্রত্যাশা করেন, ঊর্ধ্বতন কর্তারাও তাতেই খুশি।
অথচ যারা শেষ ধাপ পার করতে পেরেছে, স্কুলশিক্ষা কেবল তাদেরই কাজে লাগে, এমন কিন্তু নয়। এ বিষয়ে যেটুকু তথ্য-পরিসংখ্যান আছে, তা সাক্ষ্য দিচ্ছে যে স্কুলে কয়েক বছরের শিক্ষাও লাভজনক। দেখা যাচ্ছে, যে কখনও স্কুলে যায়নি, তার চাইতে চতুর্থ শ্রেণি অবধি পৌঁছনো পড়ুয়া যতটা লাভবান হচ্ছে, একই অনুপাতে অষ্টম-উত্তীর্ণর চাইতে দ্বাদশ-উত্তীর্ণ লাভবান হচ্ছে। সাধারণত অভিভাবকরা এই লাভকে তেমন পাত্তা দেন না। চতুর্থ শ্রেণি শেষ করার পর তো আর কোনও লোক-দেখানো কাগজ মেলে না। কিন্তু চাষবাস, দোকানদারি, যে কাজই কেউ করুক না কেন, লিখতে-পড়তে পারা, অঙ্ক কষতে পারা তাতে অনেকটা সাহায্য করে।
শিক্ষার অধিকার নিয়ে যখন কথা উঠল, তখন আশা জেগেছিল যে স্কুলে লেখাপড়া শেখার প্রয়োজনীয়তা এবার গুরুত্ব পাবে। সাফল্যের চাবি বলে শিক্ষাকে দেখার যে অযৌক্তিক উন্নাসিকতা, তা বন্ধ হবে। দুঃখের কথা, আইন তৈরি হতে দেখা গেল সেই পুরনো মানসিকতা আরও গভীর হয়েছে। কেউ কিছু শিখুক আর না-শিখুক, সিলেবাস শেষ করা এখন আইন। স্কুলের বিল্ডিং-এর চেহারা কেমন হওয়া দরকার, তা নিয়ে আইনে অনেক কথা রয়েছে। কিন্তু প্রতিটি শিশুর কয়েকটি ন্যূনতম দক্ষতা তৈরি করার জন্য স্কুলকে কী কী করতে হবে, সে-বিষয়ে একটা কথাও নেই। অথচ আইনটা স্কুলের বেঞ্চে বসে থাকার অধিকারের নয়, শিক্ষা পাওয়ার অধিকার আইন।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ১৩ নভেম্বর ২০১১