আর একটা পদ্ধতি পরীক্ষা করা হয়েছে হরিয়ানা, গুজরাত, বিহারের জেহানাবাদে। স্কুলের গোটা সময়ের থেকে নির্দিষ্ট কিছু মিনিট রেখে দেওয়া হচ্ছে কেবল লেখা আর পড়ার দক্ষতা তৈরির জন্য। ওই সময়ে প্রতিটা ছাত্রকে লিখতে আর পড়তে অভ্যাস করানো হচ্ছে। এর ফলে খামতি থাকার জন্য যারা পিছিয়ে যাচ্ছিল, তারাও দ্রুত উঠে আসছে। অর্থাৎ স্কুলের পঠনপাঠনে খুব বড় বদল না এনেও শেখানোয় উন্নতি করা যাচ্ছে। লিখতে-পড়তে শেখানোকে স্কুলের দৈনন্দিন কাজের মধ্যে গেঁথে দেওয়ায় খুব বাড়তি কোনও বোঝা চাপছে না, কিন্তু কাজ অনেক ভাল হচ্ছে। এমন ছোট ছোট পরিবর্তন করা খুব কঠিন নয়।
বড় পরিবর্তনও যে আসেনি, তা তো নয়। স্বাধীনতার সময়ে অক্ষরপরিচয় ছিল দশ জনে এক জনের। সত্তরের দশকেও দশ জনে তিন জনের। গত বছর দশ-পনেরোয় সে-ছবি আমূল বদলে গিয়েছে। এখন কার্যত ১০০ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে নাম লেখায়, প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ সাক্ষর। আজকের দুর্গা স্কুলে গিয়ে গরম খিচুড়ি-সবজি খেয়ে অপুর পাশে বসে বই খুলে পড়ছে। আপার প্রাইমারি স্কুল দূরে হলে আজকের মেঘনাদের জন্য বাড়ির কাছে তৈরি হচ্ছে মধ্যশিক্ষা কেন্দ্র। বদল তো হচ্ছেই। প্রশ্ন হল, যাঁরা সেই বদলকে আরও দ্রুত ও কার্যকর করতে পারছেন, স্কুল, শিক্ষক, শিক্ষা দফতর, অভিভাবক, সবাই তাঁদের থেকে পাঠ নিতে রাজি কি না। ছেলেমেয়েরা না-ই যদি শিখল, তবে ‘শিক্ষা’ কীসের?
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ অগস্ট ২০১৪
বেঞ্চে বসার অধিকার
শিক্ষার জন্য জওহরলাল নেহরু কম করেননি। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি), ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (আইআইএম), ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই), এবং এমন আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের তিনিই রূপকার। অথচ যাঁর জন্মদিনে শিশু দিবস পালন করা হয়, সেই মানুষটি প্রাথমিক স্কুলের প্রসারের জন্য সামান্যই করেছেন। দু’হাজার কোটিরও বেশি টাকার প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা মাত্র ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল প্রাথমিক শিক্ষার জন্য। সেটা এই জন্য নয় যে নেহরু শিশুদের নিয়ে মাথা ঘামাতেন না— উলটোটাই সত্যি— কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষাকে তাঁর এমন কোনও বড় সমস্যা বলে মনে হয়নি, যা নিয়ে তক্ষুনি কিছু করা দরকার।
মুক্ত বাজারে বিশ্বাস করেন যে অর্থনীতিবিদরা, তাঁদের সঙ্গে নেহরুর খুব বেশি মতের মিল ছিল না। কিন্তু তাঁদের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন, লোকে কোনও-না-কোনও ভাবে সন্তানদের ঠিক লেখাপড়া শেখাবে। মুক্ত বাজারের প্রবক্তারা বলেন, বাজারই স্কুল জোগাবে। তবে নেহরুর মাথায় সম্ভবত ছিল স্থানীয় মানুষ পরিচালিত স্কুল, বা অসরকারি সংস্থার স্কুলের কথা। কিন্তু দুটো ক্ষেত্রেই মূল কথা এক— বাবা-মা জানেন তাঁর সন্তানের জন্য কোনটা ভাল, আর সেটাই তাঁরা করতে চান।
এক অর্থে বলা চলে, কথাটা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। দেশের বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে এখন স্কুলে যাচ্ছে। দেশ জুড়ে গজিয়ে-ওঠা স্বল্প মাইনের বেসরকারি স্কুলে শিশুকে পাঠাচ্ছেন গরিব বাবা-মায়েরাও। বেসরকারি স্কুলে যাঁদের ভরসা, গরিবদের মধ্যেও তেমন বাবা-মায়েদের অনুপাত বাড়ছে। ছেলেমেয়ের জন্য বাবা-মায়ের সক্রিয়তার এর চাইতে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে?
এই আশা-জাগানো ছবিটা আঁকতে গিয়ে একটা জায়গাতেই হোঁচট খেতে হয়— ছেলেমেয়েরা কিছু শিখছে না। শিশুদের পড়তে-অঙ্ক কষতে পারার মূল্যায়ন করে অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট (অসর)। ‘প্রথম’ নামে একটি অসরকারি সংস্থা এই রিপোর্ট বার করে। পরপর বেশ কয়েক বছর ধরে ‘অসর’ রিপোর্টের ফল দেখাচ্ছে, পঞ্চম শ্রেণির প্রায় অর্ধেক শিশু দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্য পড়তে পারছে না। অঙ্কের ফল তো আরও খারাপ।
কেন শিখছে না শিশুরা, তা নিয়ে নানা কথাবার্তা চলছে। আজকাল সরকারি স্কুলের ব্যর্থতার নানা ব্যাখ্যা কান পাতলেই শোনা যায়। একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যত ঘণ্টা পড়ানোর কথা, সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা পড়াচ্ছেন স্রেফ তার অর্ধেক। বেসরকারি স্কুলে অবশ্য শিক্ষকদের উপস্থিতির হার অনেক ভাল। বাবা-মায়েরাও বলছেন, সেই কারণেই বেসরকারি স্কুল তাঁদের বেশি পছন্দ।
কিন্তু শিশুদের শেখানোর প্রশ্নে সরকারি স্কুলের চাইতে খুব কিছু এগিয়ে নেই বেসরকারি স্কুলগুলো। এটা ঠিকই যে, গড়পড়তা ফল বেসরকারি স্কুলে ভাল হয়। কিন্তু তা থেকে ধরে নেওয়া চলে না, সেখানে শিক্ষকরা আরও ভাল শেখাচ্ছেন। কারণ, এ-ও মাথায় রাখতে হবে যে বেসরকারি স্কুলে যাঁরা পাঠান সন্তানকে, সেই বাবা-মা তুলনায় বিত্তবান, কিংবা সন্তানের পড়াশোনার প্রতি অধিক মনোযোগী। অনেক ক্ষেত্রে দুটোই সত্যি। তাই বেসরকারি স্কুল আর সরকারি স্কুলে ছাত্রদের লেখাপড়ার মানের আসল ছবিটা কী, বোঝার জন্য ‘প্রথম’-এর পক্ষ থেকে রুক্মিণী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর সহযোগীরা একই লিঙ্গের সহোদরদের পরীক্ষার ফলের তুলনা করেন। অর্থাৎ দুই ভাইয়ের একজন যখন সরকারি, আর একজন বেসরকারি স্কুলে যাচ্ছে, তখন তাদের লেখাপড়ার ক্ষমতায় কতটা তফাত হচ্ছে, সেটা তুলনা করে দেখেন। স্কুলের পড়ানোর মানের তফাত বোঝার আদর্শ উপায় অবশ্য একে বলা চলে না। কারণ, বেসরকারি স্কুলে যে ভাই যাচ্ছে, সে আরও নানা বাড়তি সুবিধে হয়তো পাচ্ছে (যেমন পড়াশোনার সময় বেশি পেতে পারে)। কিন্তু এমন ঢিলেঢালা পরিমাপে পরীক্ষা করেও দেখা যাচ্ছে, লিখতে-পড়তে পারার নিরিখে বেসরকারি স্কুলে গিয়ে শিশুদের বাড়তি লাভ হচ্ছে সামান্যই। গরমের ছুটির সময়ে বিহারে কোনও কোনও স্কুলে সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা পাঠ-শিবির করেন। সেখানে যোগ দিলে সরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের লেখাপড়ার ক্ষমতায় কিছুটা উন্নতি হয়। ওই সব স্কুলে শিবিরের আগে-পরে পড়ুয়াদের লেখাপড়ার ক্ষমতায় যে ফারাক দেখা গিয়েছে, সেটা বরং সরকারি স্কুল-বেসরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের লেখাপড়ার ক্ষমতায় ফারাকের চাইতে বেশি।