সে-কাজ হচ্ছেও। আফ্রিকার কিনিয়াতে দেখা গিয়েছে, অসুস্থতা শিশুদের স্কুল কামাই করার একটি বড় কারণ। বছরে দু’বার কৃমির ওষুধ খাওয়ালে স্কুল-কামাই কমে অন্তত ২৫ শতাংশ। এই তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বের নানা দেশে স্কুলছাত্রদের কৃমির ওষুধ দেওয়ার কাজ চলছে, ভারতে প্রকল্প চলছে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং বিহারে। ছাত্রদের ফল অনুসারে শিক্ষকদের উৎসাহ ভাতা দেওয়ার পরীক্ষা হয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশে, তাতেও সুনির্দিষ্ট ফল পাওয়া গিয়েছে (বক্স দেখুন)।
নীতি যদি ক্লাসঘরের বাস্তব সমস্যাগুলোর দিকে না তাকায়, তা হলে শিক্ষা দফতরের কর্তাদের সদিচ্ছা জমে পাথর হবে কেবল। তাতে চাপা পড়বে বাবাই, রবির মতো শিশুদের লেখাপড়া শিখে গাড়িঘোড়া চড়ার স্বপ্ন।
কেমন করে নম্বর বাড়ে: অন্ধ্রপ্রদেশের একটি পরীক্ষা
ছাত্রদের ফল ভাল হলে যদি শিক্ষকদের বাড়তি টাকা মেলে, তা হলে কি ছাত্ররা আরও ভাল শেখে? তা বুঝতে পাঁচ বছর ধরে অন্ধ্রপ্রদেশের তিনশোটি গ্রামীণ প্রাথমিক স্কুলে (প্রথম-পঞ্চম শ্রেণি) চলে একটি পরীক্ষা। নিয়ম হয়, ছাত্রদের গড় নম্বর এক শতাংশ বিন্দু বাড়লে শিক্ষকরা পাবেন ‘বোনাস’ ৫০০ টাকা। একশোটি স্কুলে দেওয়া হয় ‘গ্রুপ বোনাস’— স্কুলের গড় নম্বর বাড়লে সব শিক্ষক সমান বোনাস পাবেন। অন্য একশোটি স্কুলে দেওয়া হয় ‘ব্যক্তিগত বোনাস’-যে ছাত্রদের একজন শিক্ষক পড়াচ্ছেন, তাদের গড় নম্বর বাড়লে সেই শিক্ষক বোনাস পাবেন। শেষ একশোটি স্কুলে (‘কন্ট্রোল গ্রুপ’) কোনও বোনাস দেওয়া হয়নি।
• ব্যক্তিগত উৎসাহ ভাতা কাজ দিয়েছে সবচেয়ে ভাল। পাঁচ বছর পরে এইসব স্কুলের ছাত্ররা অন্য ছাত্রদের চেয়ে অঙ্ক এবং ভাষায় বেশি নম্বর পেয়েছে।
• ‘গ্রুপ বোনাস’ স্কুলের ছাত্ররা প্রথম বছর উন্নতি করলেও, পাঁচ বছর পর ‘কন্ট্রোল গ্রুপ’-এর ছাত্রদের মতোই নম্বর পেয়েছে।
• ব্যক্তিগত বোনাস কেবল অঙ্ক আর ভাষার নম্বরের জন্য দেওয়া হলেও, ওই স্কুলগুলোতে ছাত্রদের বিজ্ঞান এবং সমাজ বিজ্ঞানের নম্বরেও উন্নতি হয়েছে।
এই পরীক্ষার সিদ্ধান্ত, ছাত্রদের ফল অনুসারে শিক্ষকদের বেতনের কিছু অংশ দিলে স্কুলে ছাত্রদের আরও ভাল শেখার সম্ভাবনা বেশি। দুর্বল ছাত্ররাও বেশি শিখছে এই ব্যবস্থায়।
আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব-এর তরফে এই পরীক্ষাটি করেন কার্তিক মুরলীধরন।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ এপ্রিল ২০১২
যাচ্ছে কিন্তু শিখছে না
গরিবের ছেলেকে কত কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হয়, তার গল্প কে না শুনেছে। বালক ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতায় রাস্তার গ্যাসের আলোর নীচে বসে পড়া মুখস্থ করেছেন। মেঘনাদ সাহা সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হতে দূরের গ্রামে আশ্রয়দাতার পরিবারের বাসন মেজেছেন পুকুরের ঘাটে। ঘরে-ঘরে অমন গল্পও কম নয়। ‘আমরা সাত ভাই-বোন একটা হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করেছি। আজ তোমাদের পড়ার টেবিল, টিউটর, লোডশেডিঙে ইমার্জেন্সি ল্যাম্প, তা-ও পড়াশোনা হয় না’, শুনে শুনে কত কান পচে গিয়েছে, ঠিক নেই।
এখন দেখা যাচ্ছে, কথাটা খুব ভুল নয়। দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশে স্কুল শিক্ষা খতিয়ে দেখে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সরকার এবং পরিবার আগের চাইতে ঢের বেশি খরচ করছে স্কুলের পড়াশোনার জন্য। হয়তো উন্নত দেশগুলোর মতো অতটা নয়। কিন্তু যত স্কুল তৈরি হয়েছে, যত শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে গত দশ বছরে, আগে কখনও হয়নি। ভারতের কথাই ধরা যাক। প্রথমে সর্বশিক্ষা মিশন (২০০১), পরে শিক্ষার অধিকার আইন (২০০৯) কার্যকর হওয়ার পরে গ্রামেও এখন এক কিলোমিটারের মধ্যে প্রাথমিক স্কুল। স্কুলে বাড়তি ক্লাসঘর, বাড়তি শিক্ষক, বিনা পয়সায় পাঠ্যবই, শৌচাগার, মিড-ডে মিল, সব জোগানো হচ্ছে। ইস্কুলে যাওয়া আজও সহজ নয় অনেকের কাছে, কিন্তু আগের মতো কঠিনও নয়।
অথচ ছেলেমেয়েরা শিখছে অতি সামান্য। এক শ্রীলঙ্কা ছাড়া, দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে স্কুলপড়ুয়ারা আন্তর্জাতিক গড়ের চাইতে অনেক পিছিয়ে। প্রাথমিক স্কুল থেকে যারা বেরোচ্ছে, তাদের এক-তৃতীয়াংশ থেকে এক-চতুর্থাংশ লেখা, পড়া, অঙ্ক কষার গোড়ার কাজগুলো পারছে না।
কথাগুলো খুব নতুন নয়। তবে তার ব্যাখ্যাটা সাধারণত হয় এ রকম, ‘ওরা গ্রামের গরিব ছেলেমেয়ে। বাপ-মা কোনও দিন পড়াশোনা করেনি। স্কুলে নাম লেখাতে পেরেছে, তা বলে পড়াশোনা কি আর করতে পারবে? অতই সোজা?’ তাই না-শেখার সংকট নিয়ে শহুরে মধ্যবিত্ত বিশেষ মাথা ঘামায় না। এই রিপোর্টে কিন্তু দেখা যাচ্ছে, চিন্তার কারণ আছে।
শিক্ষকরা যখন তাঁদের পড়ানোর বিষয়টি সম্পর্কে জানেন (অনেকেই জানেন না— বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের মাত্র ৪৭ শতাংশ প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক প্রাথমিকের অঙ্ক ঠিক কষতে পেরেছেন), তখন তাঁরা অনেকেই বিষয়টি ছাত্রদের বোঝাতে পারছেন না।
একটি সমীক্ষায় পাকিস্তানের মাত্র ৩৬ শতাংশ শিক্ষক দু’সংখ্যার যোগ বোঝাতে পেরেছেন ছাত্রদের। নামীদামি স্কুলের শিক্ষকরাও কিন্তু একই প্রশিক্ষণ পেয়ে এসেছেন। ফলে নামী স্কুলের পড়ুয়াও ক্লাসের পড়া বুঝতে পারছে না। আমরা বলছি, ছেলেমেয়ের মন নেই, মাথা নেই। কিন্তু পাঠদানেই দক্ষিণ এশিয়ায় খামতি রয়ে গিয়েছে, বলছে রিপোর্ট। চিনের সাংহাইয়ের উদাহরণ দিয়ে বলা হচ্ছে, সেখানে নতুন শিক্ষকরা অভিজ্ঞ শিক্ষকদের ক্লাসে উপস্থিত থাকেন। পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষানবিশি চলতে থাকে। একই বিষয়ের শিক্ষকরা একসঙ্গে বসে পাঠ-পরিকল্পনা করেন। ফলে পড়ানো ভাল করার দিকে সহায়তা, সচেষ্টতা থাকছে শিক্ষকদের। যেটা ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে না, বলছে রিপোর্ট।