লজ্জায়, বিরক্তিতে যারা স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে, তাদের অনেকেই কিন্তু কাজ করতে গিয়ে হিসেব করছে দিব্যি, কাজ-চালানোর মতো পড়তে-লিখতেও পারে। যার কথাবার্তায় জড়তা নেই, মুখে-মুখে অঙ্ক করায় ভয় নেই, পাঁচজনের সঙ্গে মিশে নিজের কাজ হাসিল করার মতো জটিল কাজও যে করতে পারে, তার খাতায় বছর বছর কেন পড়ত লাল কালির দাগ? ওই খোকা-খুকুরা ফেল করছে, নাকি ফেল করছে শিক্ষা দফতরের বুড়ো খোকারা?
শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে বোঝা যায়, ‘কী পড়ানো হবে,’ সেই প্রশ্নটা আলোচনার জমির প্রায় সবটা দখল করে বসে রয়েছে। এ রাজ্যে নতুন সরকার এসেই প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠক্রমে কী কী পড়ানো হবে তাই নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করেছিল। তার নানা প্রস্তাবের মধ্যে কতগুলো সরকার গ্রহণ করেছে, কতগুলো করেনি, কমিটি থেকে কাদের বাদ দেওয়া হয়েছে, কারা ঢুকেছে তা নিয়ে মিডিয়াতে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। কিন্তু যেটা শিক্ষার একেবারে গোড়ার কথা— ছেলেমেয়েরা স্কুলে গিয়েও কেন বই পড়তে, অঙ্ক কষতে শিখছে না, সে-প্রশ্নটা প্রায় না-ছোঁয়া রয়ে যাচ্ছে। দেখেশুনে শেয়ালকে সূপ খাওয়াতে বকের নেমন্তন্ন করার গল্প মনে পড়ে যায়। কুঁজোর ভিতরের বস্তুটি অতিশয় পুষ্টিকর হতে পারে, কিন্তু পাত্রটি এমনই যে শেয়াল বেচারিকে পাত্রের গা চেটে খিদে-পেটে ফিরতে হয়। আমাদের ছেলেমেয়েরাও তেমনি পাঁচ-আট-দশ বছর স্কুলে বসেও অঙ্ক-বাংলা-ইংরেজির নাগাল না পেয়ে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।
এ বার ‘কী পড়ানো উচিত’ তা নিয়ে অকারণ কচকচি বন্ধ করে ‘কী করে পড়ানো উচিত’ সেই প্রশ্নে আসতে হবে। অক্ষর চিনে শব্দ, শব্দ জুড়ে বাক্য পড়তে শেখাটাই যদি প্রথম দরকার হয়, তা হলে কোন বই পড়ে শিশু তা শিখছে, সেটা অত কিছু জরুরি নয়। যদি ‘হাঁদা-ভোদা’ কমিকস পড়তে শিশুরা ভালবাসে, তা হলে তা থেকেই শিক্ষক প্রশ্ন করবেন না কেন? সব শিশুকে একই পাঠ্যবই থেকে পড়তে শিখতে হবে, এটাও জুলুম ছাড়া কিছু নয়। যা ভাল লাগবে, তা-ই পড়বে। ‘সহজ পাঠ’ যে সফল, তার কারণ রবীন্দ্রনাথের অসামান্য শব্দচয়ন শিশুদের কান, মন টেনে আনে অক্ষরগুলোর দিকে। তবু আজকের শিশুর কাছে যদি ‘বড় বৌ মেজ বৌ মিলে, ঘুঁটে দেয় ঘরের পাঁচিলে’ তেমন ইন্টারেস্টিং ছবি তৈরি না করে, তা হলে তাকে অন্য বই পড়াতে হবে। বাঁকুড়ায় যা পড়ানো হবে, জলপাইগুড়িতে তা পড়ানো না-ও হতে পারে। ‘কী পড়ল’ সেই ছুতমার্গে না গিয়ে, কতটা শিখল, সেটাই দেখার দরকার শিক্ষা দফতরের। পড়তে যদি সে শেখে, পড়ার আগ্রহ যদি তার জন্মায়, তবে আখেরে সে পড়বে এবং জানবে অনেক বেশি। স্কুলের গোড়াতেই তার মগজে বিগ ব্যাং থেকে শ্রেণি সংগ্রাম পর্যন্ত সব গুঁজে দেওয়া অর্থহীন। অন্তত প্রাথমিকের ক্ষেত্রে শিক্ষা দফতর কেবল দক্ষতার ন্যূনতম মাপকাঠি স্থির করে দিলেই যথেষ্ট— দ্বিতীয় শ্রেণিতে একটি ছাত্রকে কী কী পারতে হবে, তৃতীয় বা চতুর্থতে আরও কী কী তার করতে পারা দরকার। কোন কোন বই পড়ে, কতগুলো অনুশীলনী কষে সে ওইসব দক্ষতা আয়ত্ত করবে, সেটা শিক্ষক বুঝবেন। ‘কী কী জানল’ সেটা শিক্ষার মাপকাঠি নয়, ‘কী কী পারে,’ সেটাই মাপকাঠি।
কী পারছে, তা বুঝতে পরীক্ষা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু সেই পরীক্ষার দরকার শিক্ষাপদ্ধতির মূল্যায়ন করতে। ছাত্ররা কে কত পেল, সে-তালিকা প্রকাশেরই দরকার নেই। দরকার শ্রেণির সাফল্য-ব্যর্থতার মোট ছবিটা তুলে ধরা। দ্বিতীয় শ্রেণির ৭০ শতাংশ ছেলেমেয়ে যদি ৬৪ থেকে ৩১ বিয়োগ করতে ভুল করে, কিংবা ৬০ শতাংশ ‘কাল ছিল ডাল খালি’ ছড়াটা গড়গড় করে পড়তে না পারে, তা হলে বাপ-মায়ের ‘চেতনার অভাব’ কিংবা শিশুর বেয়াড়াপনার উপর দায় চাপানো চলবে না আর। স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ক্লাসের পড়ানোয় গলদ আছে।
কেন পড়াশোনা হচ্ছে না, সেটা শিক্ষক ক্লাসে আসছেন না বলে, নাকি ক্লাস ঘর নেই বলে, সে-খবর শিক্ষা দফতরের রাখা চাই। ‘স্কুল ইনস্পেকটর’ স্কুলগুলিতে গিয়ে নিয়মিত পরিদর্শন করার যে রীতি আগে প্রচলিত ছিল (যার জন্য স্কুলগুলোকে কত সাজগোজ করে তৈরি থাকতে হত তার বিবরণ বহু গল্পে পাওয়া যায়) এখন তা প্রায় উঠে গিয়েছে। অথচ নিয়মিত স্কুল পরিদর্শনের কোনও বিকল্প নেই। কী পড়া হবে, তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, কেমন পড়ানো হচ্ছে তার খোঁজ রাখা শিক্ষা দফতরের কাছে অনেক জরুরি কাজ।
অন্য কাজটি হল, শেখার তাগিদ, শেখানোর তাগিদ কী করে বাড়ে, তার উপায় খোঁজা। সত্তর-আশির দশকে মনে করা হয়েছিল, যত বেশি স্কুল খোলা হবে, যত শিক্ষক রাখা হবে, যত বেশি শিশুদের আনা যাবে স্কুলে, তত প্রসার হবে শিক্ষার। গত দুই দশকে দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকায় প্রচুর স্কুল খোলা হয়েছে, বহু দরিদ্র দেশে প্রায় ৯০ শতাংশ ছোট ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। অথচ নানা সমীক্ষায় ধরা পড়ছে যে, ছেলেমেয়েরা শিখছে সামান্যই। কেবল স্কুল খুলে রাখলেই শিশুরা যথেষ্ট লেখাপড়া শিখবে না, সেটা এতদিনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
তাই নানা দেশে-প্রদেশে নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে, কীভাবে শেখালে কাজ হয়। শিক্ষক-অভিভাবক-ছাত্রদের কী ধরনের পুরস্কার দিলে (বা শাস্তি দিলে) তারা পড়ায় আগ্রহী হবে। কীসে বিনিয়োগ করলে লাভ হবে বেশি— স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ, নাকি পার্শ্বশিক্ষক নিয়োগ, নাকি শিক্ষকদের বাড়তি অনুদান? ছেলেমেয়েরা কত সামান্য শিখছে সে-বিষয়ে বাবা-মাকে জানালে কি তাঁরা স্কুলের উপর চাপ তৈরি করেন? নাকি ভাল নম্বর-পাওয়া ছাত্রদের স্কলারশিপ দিলে বাবা-মা বেশি যত্ন নেবেন সন্তানের পড়াশোনায়? এ সব প্রশ্নের নানা উত্তর পাওয়া যাচ্ছে। ভাল পড়াশোনা শেখার সূত্র যদি বার করতে হয়, তবে হাতে-কলমে এমন সব কাজের থেকেই তা বেরোবে। রবীন্দ্রনাথ, মার্ক্স, বিবেকানন্দ কী বলে গিয়েছেন সেই ‘শিক্ষার আদর্শ’ থেকে নয়, কেরল মডেল বা ব্রিটিশ মডেল থেকে নয়, ‘আমরা তো এমন করেই শিখেছি’ গোছের আলগা বিশ্বাস থেকে নয়। কীসে কাজ হয়, তার সাক্ষ্য-প্রমাণ খুঁটিয়ে দেখে নীতি তৈরি করতে হবে।