গত এক বছরে ভারতের জনসমাজের ডিসকোর্স থেকে কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট হয়। অণ্ণা হজারে তাঁর দীর্ঘ আন্দোলনে মহারাষ্ট্রে দুর্নীতি কত কমাতে পেরেছেন, তা প্রায় কেউ জানত না। দুর্নীতি কমানোর যে-দাওয়াই তিনি দিয়েছেন, সেই লোকপাল-এর ঝুঁকি কী, সুবিধে কী, তা নিয়েও মিডিয়া বা জনসমাজে খুব বেশি কিছু আলোচনা হয়নি। তবু তিনিই যে দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনের নেতা হয়ে উঠলেন, সে তাঁর সন্ত-সদৃশ জীবনযাত্রার দৌলতে। বহু মানুষের চোখে সততার ‘প্রতীক’ তিনি, তাঁর ইমেজ একটা সময়ে প্রায় সব জননেতাকে অতিক্রম করে গেল। সেই জন্যই তাঁর প্রস্তাবিত ‘লোকপাল বিল’ জনসমাজে মান্যতা পেল। তার ঠিক বিপরীত প্রান্তে রয়েছেন মন্টেক সিংহ আলুওয়ালিয়া। তাঁর জীবনযাত্রায় দারিদ্রের কোনও ছাপ নেই, গরিবের সঙ্গে রুটি ভাগ করে খেতে দেখা যায়নি তাঁকে, আগাগোড়া মুক্ত অর্থনীতির পক্ষে সওয়াল করায় তিনি বামপন্থীদের চক্ষুশূল, ‘গণশত্রু’ বলে এক রকম চিহ্নিতই হয়ে ছিলেন বহুদিন। গরিবের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তিনি গ্রহণযোগ্য নন বলেই তাঁর পেশ করা দারিদ্রসীমা গ্রহণযোগ্য হল না। তিনি যে দারিদ্রসীমার যুক্তি-তর্ক খুব প্রাঞ্জলভাবে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন এমন নয়। বরং তাঁর নানা মন্তব্য, যেমন, ‘যে ভাবেই বিচার করো, দারিদ্র কমেছে’ বিরোধীদের আরও চটিয়ে দিয়েছে। তিনি আগাগোড়াই প্রতিপক্ষকে ‘ডিসমিস’ করে দিয়েছেন, বোঝাপড়ার চেষ্টা করেননি। কিন্তু চেষ্টা করলেও ফল হত কি? মন্টেক খারিজ হয়েই ছিলেন, তাই দারিদ্রসীমা খারিজ হল।
এটা ভারতের জনসমাজে ডিসকোর্সের সমস্যা, নীতি তৈরিরও সমস্যা। ঠিক নীতি কী, তা বিচার করতে গেলে ‘কী বলা হচ্ছে’ তা না দেখে ‘কে বলছে’ সেটা বড় হয়ে ওঠে। বক্তার অবস্থানের চাইতে তার অভিব্যক্তি গুরুত্ব পায় বেশি। নীতি বা প্রকল্পের দ্বারা প্রার্থিত ফল কতটা হবে, কেমন করে হবে, সে-বিচারের চাইতে নীতি বা প্রকল্পের উদ্দেশ্যের মহানুভবতা যেন আরও বড় বিচার্য। যে জনস্বার্থ মামলার সূত্রে দারিদ্রনীতি নিয়ে এত বিতর্ক হল, সেই খাদ্য নিরাপত্তার দিকে তাকালেও তা স্পষ্ট হয়ে যায়। গরিব যথেষ্ট পুষ্টি পায় না, তাই তার হাতে প্রতি সপ্তাহে খাদ্যশস্যই তুলে দিতে হবে। পুষ্টির ব্যবস্থা হয়তো আরও সহজে, কম খরচে, দ্রুত করা যেত যদি রাজ্যগুলো তাদের সুবিধে অনুসারে গরিবদের ফুড স্ট্যাম্প দিত, বা টাকা দিত, কিংবা রেশন ব্যবস্থাই চালু রাখত। কিন্তু এমন কেজো সমাধানে কেউ খুশি হয় না। রাশি রাশি চাল-গমই তুলে দেওয়া চাই গরিবের ঝুলিতে, কারণ সরকারের সদিচ্ছার সেরা অভিব্যক্তি হবে সেটাই। যা শুনতে ভাল, যা দেখতে ভাল, যা বলতে ভাল, সেটাই ভাল নীতি। মুশকিল হল, জনসমাজের ডিসকোর্সের এই রীতিতে আর যারই ভাল হোক, গরিবের হয় না। গরিবকে মর্যাদা দিতে হলে তার পছন্দ-অপছন্দ, আশঙ্কা-উচ্চাশা সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য-পরিসংখ্যানকে মর্যাদা দেওয়া চাই। দারিদ্র কমানোর প্রকল্পের কার্যকারিতা বিষয়ে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানকে মর্যাদা দেওয়া চাই। ভাল সংখ্যা না হলে ভাল নীতি তৈরি করা অসম্ভব।
এই উপলব্ধি বিশেষজ্ঞদের একটা ছোট বৃ্ত্তে রয়ে গিয়েছে, জনসমাজের বৃহত্তর পরিধিতে এখনও ছড়িয়ে যায়নি। আমাদের জনসমাজের ডিসকোর্স বৃহৎ সমীক্ষালব্ধ, জটিল বিচারলব্ধ সংখ্যাকেও সম্পদ মনে করে না। বরং তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে তাকে সন্দেহ করে, তাচ্ছিল্য করে। চিন্তার এই দারিদ্রেই নোঙর গেঁথেছে ভারতের দারিদ্র।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য, বারোমাস, ২০১২