কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী কে ভি টমাস কেরলের মানুষ, তেণ্ডুলকরের হিসেবে তাঁর রাজ্যে গরিব জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ। দারিদ্রসীমা উঠে যেতে রাজনৈতিক ফায়দা হল তাঁর। কোথায় কত গরিব তা যে হেতু আর নির্ধারণ করা যাচ্ছে না, তাই সব রাজ্যে এখন দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে স্বল্পমূল্যের শস্য দেওয়া হবে। অর্থাৎ দারিদ্রসীমা থাকলে কেরল যত শস্য পেত, তার অন্তত আড়াই গুণ বেশি পাবে।
সব রাজ্যকে সমান সুবিধে দেওয়া হবে, এ কথাটা শুনলে আপাতদৃষ্টিতে ন্যায্য বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে এর চেয়ে বড় অন্যায় আর কিছু নেই। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা (২০০৯-১০) অনুসারে বিহারের গ্রামবাসীদের প্রায় ৯০ শতাংশ, আর উত্তরপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, কর্ণাটক এবং পশ্চিমবঙ্গের গ্রামবাসীদের প্রায় ৮০ শতাংশ বাঁচেন দিনে ৩৫ টাকারও কমে। সেখানে হিমাচল, পঞ্জাব, হরিয়ানা, কেরলে (সম্ভবত দিল্লি আর গোয়াতেও) অর্ধেকেরও কম গ্রামবাসী ওই টাকায় দিন চালান, এ সব রাজ্যে অধিকাংশের ব্যয়ক্ষমতা বেশি। এদেরকেও যদি গরিব রাজ্যদের সঙ্গে সমান করে দেখা হয়, তার মানে দাঁড়াবে এই যে, কেরলে যাঁরা দিনে ৩৫ টাকার বেশি খরচ করতে পারেন এমন অনেক মানুষও সস্তায় চাল-গম পাবেন। আর বিহার-উত্তরপ্রদেশে বহু মানুষ যাঁদের ৩৫ টাকাও খরচের সাধ্য নেই তাঁরা ভর্তুকির চাল-গম পাবেন না। গরিব মানুষটি কেরলে না জন্মে উত্তরপ্রদেশে জন্মেছেন বলে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হলেন, এটা কেমন ন্যায়?
দারিদ্রসীমা যত নীচে নামানো হবে, তত বেশি সহায়তা পাবে গরিব-প্রধান রাজ্যগুলো। যত তা উপরে ওঠানো হবে, দারিদ্রসীমা রাখা হবে ৫০, ৮০ বা ১০০ টাকায়, তত বেশি সুবিধে পাবে তুলনায় ধনী রাজ্যগুলো। দারিদ্রসীমার বিরুদ্ধে প্রবল সমালোচনা করে যাঁরা গরিবের জন্য দরদ দেখিয়েছিলেন, তাঁদের জন্য এমন এক নীতির সূচনা হয়েছে যাতে এখন মার খাচ্ছে গরিবই।
নীরবতার শব্দ
ভারতে রাজনৈতিক নেতারা অর্থনীতি বোঝেন না, এমন নয়। দারিদ্রসীমা থেকে খাদ্য নিরাপত্তার প্রকল্পকে বিযুক্ত করে দিলে তার ফল কী হবে, তা-ও তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন। একশো দিনের কাজের পর ইউ পি এ সরকারের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনা খাদ্য নিরাপত্তা আইন। অথচ তার যথাযথ রূপায়ণ করার তাগিদে, কিংবা যোজনা কমিশনের মর্যাদা (বা সুরেশ তেণ্ডুলকরের মর্যাদা) রক্ষার তাগিদে, এমনকী বিরোধীদের আক্রমণ ঠেকাতেও মুখ খুললেন না প্রধান নেতারা। তাই এই বৎসর-ব্যাপী বিতর্কের দিকে তাকিয়ে ‘কী হল, কেন হল’ বোঝার চেষ্টা করলে মনে পড়ে যায় গল্পের গোয়েন্দা শার্লক হোমসের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘কিন্তু কুকুরটা ডাকল না কেন?’ কোথায় ভুল হচ্ছে, কী ভুল হচ্ছে, তা বুঝেও চুপ করে থাকলেন মনমোহন সিংহ, প্রণব মুখোপাধ্যায় কিংবা পি চিদাম্বরমের মতো প্রথম সারির নেতারা। দারিদ্রসীমার প্রয়োজন নিয়ে তাঁরা মিডিয়ার সামনে বিবৃতি দিলে আলোচনার ধারা-প্রকৃতির উপর একটা প্রভাব পড়তে পারত। তাঁদের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিতে মিডিয়া বাধ্য থাকায় দারিদ্রসীমার বিষয়ে প্রয়োজনীয় কথাগুলো জনসমাজের নজর এড়িয়ে যেতে পারত না।
কেন তাঁরা মুখ খোলেননি, তা আন্দাজ করা অবশ্য কঠিন নয়। ২০১১ ছিল একের পর এক ‘স্ক্যাম’ ফাঁস হওয়ার বছর। টু-জি কাণ্ডে ফেব্রুয়ারিতে গ্রেফতার হলেন টেলিকম মন্ত্রী এ রাজা, এপ্রিলে কমনওয়েলথ গেমসে দুর্নীতির দায়ে সুরেশ কালমাডি। এপ্রিলের গোড়ায় অণ্ণা হজারে তাঁর দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন শুরু করলেন দিল্লিতে, অপ্রত্যাশিত সাড়া জাগাল তাঁর অনশন। দুর্নীতিগ্রস্ত, দরিদ্রের শত্রু বলে সরকারের গায়ে যে দাগ লাগল, ‘গরিব-বিরোধী’ দারিদ্রসীমাকে সমর্থন করে সেই দাগকে আরও গাঢ় করার ঝুঁকি কোনও নেতা নিতে চাইবেন না, সেটাই প্রত্যাশিত। পঞ্চায়েত মন্ত্রী জয়রাম রমেশ কেবল একবার সাংবাদিক বৈঠক করলেন মন্টেক সিংহ আলুওয়ালিয়ার সঙ্গে, বললেন রাজ্যগুলো কেন্দ্রের থেকে বেশি করে টাকা আদায় করতে দারিদ্র বেশি দেখাতে চায়। এ নেহাত চাপান-উতোরের কথা, এবং পুরো সত্যি নয়। বেশি টাকাই বিরোধিতার মূল কারণ হলে বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ দারিদ্রসীমাকে সমর্থন করত।
তা তারা করেনি, কারণ রাজনৈতিক বিরোধিতা দারিদ্রসীমা বিরোধিতার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। বিহার, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, চারটি রাজ্যই রয়েছে বিরোধী জোট এন ডি এ-র শাসনে। ওড়িশায় বিজুর জনতা দল আগে এন ডি এ-র শরিক ছিল, এখন তৃতীয় ফ্রন্টে। উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টি এবং পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা কংগ্রেসের সঙ্গে সুবিধেমতো হাত মিলিয়েছেন, আবার প্রয়োজনে কংগ্রেসকে অপদস্থ করে চাপ সৃষ্টি করেছেন। মিডিয়া এবং নাগরিক আন্দোলনের নেতারা যেখানে যোজনা কমিশন এবং সরকারকে শূলে চড়িয়েই রেখেছে, সেখানে সরকারকে সমর্থন করে তাঁরা নিজেদের ঝুঁকি টেনে আনবেন, তার কোনও সম্ভাবনা ছিল কি? বরং একজন দারিদ্রসীমার বিরুদ্ধে সুর চড়ালে অন্যদের আরও সুর চড়ানোই নিরাপদ বলে মনে হওয়া ছিল স্বাভাবিক। গণতন্ত্রের তত্ত্ব বলে, ভোটদাতার স্বার্থরক্ষাই নেতাদের কাজ। এখানে রাজনীতি ঘুরে গেল উলটো দিকে— গরিব রাজ্যের জনপ্রতিনিধিরা নিজের রাজ্যের অধিকাংশ ভোটদাতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। দারিদ্রসীমার বিরোধিতা করে দরিদ্রের উন্নয়নের জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা বাড়তি পাওয়ার সম্ভাবনাকে কার্যত বাতিল করে দিলেন।