এদিকে মিডিয়ার নানা রিপোর্টে কিছু ভুল বারবার উঠে এসেছে, যা এতই মৌলিক যে আশ্চর্য না করে পারে না। যেমন, দৈনিক ১.২৫ ডলার খরচের নীচে বাঁচলে গরিব, বিশ্বব্যাঙ্কের এই নিরিখে অনেকেই ৩২ টাকাকে আন্তর্জাতিক দারিদ্রসীমার কম বলেছেন। এমনকী টাইমস ম্যাগাজিন-এও ৩২ টাকাকে ৬৫ সেন্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে (৪ অক্টোবর, ২০১১)। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতার সমতার হিসেবে মার্কিন ডলার ভারতে ১৯ টাকা। সে হিসেবে ভারতের দারিদ্রসীমার সব ক’টি প্রস্তাবিত অঙ্কই ছিল আন্তর্জাতিক সীমার উপরে। আবার, ২০১২ সালে যোজনা কমিশন শহরের দারিদ্রসীমা ২৮.৬৫ টাকা ঘোষণা করার পর মিডিয়াতে অনেক হইচই হল যে, ২০১১ সালের হলফনামার ৩২ টাকার চাইতে কমিশন আরও কমিয়ে দিয়েছে দারিদ্রসীমা। অথচ ৩২ টাকার অঙ্ক ছিল ২০১১ সালের বাজার দর অনুসারে, আর ২৮ টাকার অঙ্ক ২০০৯-১০ সালের দর অনুসারে। নানা সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন যে, তেণ্ডুলকর কমিটির পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে দরিদ্রের সংখ্যা কমাতে। বাস্তব ঠিক উলটো, তেণ্ডুলকর কমিটি গ্রামীণ দারিদ্রসীমা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়, এবং যোজনা কমিশন তা মেনেও নেয়। তার ফলে ২০০৯ সালে গরিবের সংখ্যা বাড়ে প্রায় ১২ কোটি।
এমন নানা ভ্রান্তি কেবল যে মিডিয়ার মনোযোগের অভাব নির্দেশ করে, তা নয়। সংখ্যার প্রতি সম্মানের অভাবও নির্দেশ করে, যা এক বৃহত্তর সমস্যার প্রকাশ। বড় মাপের সমীক্ষা এবং তার ফলের উপর অঙ্ক কষে পাওয়া সংখ্যার অর্থ, বা তার প্রয়োজন সম্পর্কে খুব কিছু চিন্তা না করেই তা নিয়ে মন্তব্য করা, এই সবটাই অবৈজ্ঞানিক মন, প্রশিক্ষণহীন চিন্তার ইঙ্গিত দেয়। এম জে আকবরের মতো শ্রদ্ধেয় সাংবাদিকও এর ব্যতিক্রম নন। ২০০৯ সালে কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে তিনি লিখলেন, ইউ পি এ-র সময়ে ভারতে দারিদ্র বেড়ে গিয়েছে ২০ শতাংশ। বাড়তি ৫৫ মিলিয়ন মানুষ চলে গিয়েছেন দারিদ্রসীমার তলায় (দ্য পায়োনিয়র, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০০৯)। এই গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখক বুদ্ধদেব ঘোষ কিন্তু জানিয়েছেন, আকবরের এই তথ্যগুলি তাঁদের বক্তব্য নয়। ‘আমাদের রিপোর্টে ২০০৯-১০ সালের তথ্য-পরিসংখ্যান কিছুই ছিল না। দারিদ্র কত শতাংশ বেড়েছে, বা কত বাড়তি লোক গরিব হয়ে গিয়েছে, তা কিছুই বলার মতো সংখ্যা হাতে ছিল না তখন।’
মিডিয়ার এমন নানা মৌলিক ভ্রান্তি নিয়ে তখন বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ কলম ধরেছিলেন। হিন্দুস্থান টাইমস-এ কিরীট পারিখ, টাইমস অব ইন্ডিয়াতে-এ অরবিন্দ পানাগড়িয়া, ইকনমিক টাইমস-এ স্বামীনাথন আয়ার, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ পার্থ মুখোপাধ্যায়, ডেকান হেরাল্ড-এ অলোক রায় প্রমুখ চেষ্টা করেছেন তেণ্ডুলকর পদ্ধতি এবং দারিদ্রসীমার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে। কিন্তু তাঁদের কথা বুঝতে সময়, ধৈর্য লাগে। সাংবাদিকরাই সেই ধৈর্য দেখাননি, সাধারণ পাঠক-দর্শক দেখাবেন তা আশা করা যায় না। বরং ‘২৮ টাকায় পেট ভরে না’ কথাটা চট করে বোঝা যায়। অর্থনীতিবিদরা পালটা অভিযোগ করেছেন, টি ভি অ্যাঙ্কর আর পত্রিকা সাংবাদিকরা কি মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকার বেশি মাইনে দেন বাড়ির কাজের লোক, ড্রাইভারকে? মনে রাখতে হবে ড্রাইভার তার মাইনেতে চার-পাঁচটা পেট চালায়। রিপোর্টারদের ‘কপট ক্ষোভ’ বিষয়টাকেই গুলিয়ে দিল মানুষের কাছে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
‘গরিবদের গুলি করুন, বিষ দিন’: দারিদ্রের রাজনীতি
এমনই নাটকীয় ভাষায় সংসদে দারিদ্রসীমার বিরোধিতা করেছিলেন শারদ যাদব। তিনি সংযুক্ত জনতা দলের সদস্য এবং এন ডি এ-র আহ্বায়ক। তেণ্ডুলকর পদ্ধতি অনুসারে যোজনা কমিশন ২০০৯-১০ সালের জন্য শহরে দারিদ্রসীমা ২৮ টাকা বলে নির্দিষ্ট করায় রাজনৈতিক দলগুলি হইচই জুড়ে দেয়। শরদ যাদব বলেন, ‘এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে কেউ এক মত নয়।’ অথচ আশ্চর্য এই যে, এই তথ্যের সঙ্গে এক মত হওয়ার সব চাইতে বেশি কারণ ছিল বিহার আর উত্তরপ্রদেশের। কারণ দরিদ্রের সংখ্যা অনুপাতে রাজ্যগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান পায়। যে রাজ্যে বেশি গরিব, সেই রাজ্যে বেশি টাকা পৌঁছয়। যোজনা কমিশনের দারিদ্রসীমা ধরলে শতাংশের হিসেবে রাজ্যগুলির মধ্যে সর্বাধিক গরিব রয়েছে বিহারে (জনসংখ্যার ৫৩.৫ শতাংশ, ৫.৪৩ কোটি মানুষ) আর সংখ্যার হিসেবে সর্বাধিক গরিব রয়েছে উত্তরপ্রদেশে (৭.৩৭ কোটি মানুষ, জনসংখ্যার ৩৭.৭ শতাংশ)। অতএব যোজনা কমিশনের পরিসংখ্যান মানলে অন্য রাজ্যগুলোর তুলনায় অনেক বেশি কেন্দ্রীয় অনুদান আসত বিহার এবং উত্তর প্রদেশে। যদি যোজনা কমিশনের নির্দিষ্ট দারিদ্রসীমা না মানা হয়, কিংবা যদি ৮০ টাকা বা ১০০ টাকা দারিদ্রসীমা ধরা হয়, তা হলে কার্যত সব রাজ্যে গরিবের সংখ্যা এক হয়ে যাবে। তখন রাজ্যগুলির মধ্যে সম্পদবণ্টনের কোনও মাপকাঠি থাকবে না, এক মাত্র উপায় হবে সব রাজ্যে সমান অনুপাতে বণ্টন। হিসেব কষলে দেখা যাবে, সব রাজ্যে সমান অনুপাতে মানুষ বি পি এল ধরে কেন্দ্র অনুদান দিলে যোজনা কমিশনের দারিদ্রসীমা অনুসারে বণ্টনের চাইতে উত্তরপ্রদেশ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা কম পাবে, বিহার পাবে সাত হাজার কোটি টাকা কম। তাই সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, যোজনা কমিশনের দারিদ্রসীমা মানার জন্য জোর সওয়াল করবেন বিহার, উত্তরপ্রদেশের প্রতিনিধিরা। অথচ সংসদে শারদ যাদব বললেন, ‘বাস্তব থেকে দূরে রয়েছেন আলুওয়ালিয়া। তিনি কথা বললেই গণ্ডগোল বেধে যায়। তিনি কখনও একটা ভাল কথা বলেননি… এ ভাবে দারিদ্র দূর করার চাইতে গরিবদের গুলি করে, বিষ দিয়ে মেরে দেওয়া ভাল।’ উত্তরপ্রদেশের সাংসদ, সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং বললেন, যোজনা কমিশন দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। বত্রিশ টাকায় জলখাবারও হয় না, মানুষ তাতে বাঁচবে কী করে? তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই উন্নয়নের অনুদানের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে কেন্দ্রের উপর। দরিদ্রের মোট সংখ্যার বিচারে পশ্চিমবঙ্গ ভারতে পঞ্চম (২ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ), কিন্তু সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় দারিদ্রসীমার বিরোধিতা করে বললেন, যোজনা কমিশনকে আবার পুরো বিষয়টা চিন্তা করতে হবে।