একটা মত হল, ভুল হচ্ছে রাজনীতিতে। রাজনীতির আদর্শ, তার পদ্ধতি-প্রক্রিয়া ঠিক না হলে গরিবের জন্য ভাল ভাল প্রকল্প তৈরি করে লাভ নেই। রাজনৈতিক আদর্শ ঠিক হলে প্রকল্পও ঠিক হবে। তা যদি না হয়, তা হলে নীতি-প্রকল্প কখনওই ঠিকমতো কাজ করবে না। আগে রাজনীতি, তারপর অর্থনীতি। গরিবের কাছে কোনও দিন ৮৩ পয়সা যদি না পৌঁছয় তা হলে এক টাকা খরচ করার সেরা পদ্ধতি নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী করবেন অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা? রাজনৈতিক ব্যবস্থার খোল-নলচে পালটে না দিলে গরিবের লাভ নেই। এক কথায়, বিপ্লব করতে হবে। তা সহজ নয়। কিন্তু দারিদ্রের মতো বৃহৎ সমস্যার সমাধান ছোটখাটো উপায়ে হবে না, তার জন্য সামাজিক বিপ্লবের মতো ‘বৃহৎ’ উত্তরই চাই। সরকার ফেলে দিতে হতে পারে, আইন বা বিধিব্যবস্থা বদলাতে হতে পারে।
সার্বিক বিপ্লবের কথা অনেকে বলেছেন, অন্তত কার্ল মার্ক্সের সময় থেকে তা রীতিমতো পরিচিত হয়ে উঠেছে। তারপরেও অর্থনীতির চর্চায় এমন ‘সার্বিক পরিবর্তন’-এর পক্ষে সওয়াল করেছেন অনেকে। যদিও তা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে।
একটি মত বলে, গরিব দেশ যে গরিব থেকে যায়, তার কারণ তাদের বিধিব্যবস্থাগুলো খারাপ। আইন, সরকারি নীতি, সামাজিক নীতি, এগুলো বৈষম্য, নির্যাতন, অদক্ষতা, আলস্যকে প্রশ্রয় দেয়। গবেষকরা দেখিয়েছেন, আফ্রিকা বা এশিয়ার যেসব দেশে রোগের আধিক্য বা অন্যান্য কারণে ইউরোপীয়রা নিজেরা বসবাস করেনি, দূর থেকে শাসন চালিয়েছে, সে সব কলোনিতে বিধিব্যবস্থা ছিল অতি খারাপ। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ ইউরোপীয়রা সে সব দেশ থেকে যথাসম্ভব কম খরচে যথাসম্ভব বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। সে সব জায়গায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির সুরক্ষা, আইনের শাসন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ, কিছুরই ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। বেলজিয়মের কলোনি আফ্রিকার কঙ্গো দেশটি এর একটা উদাহরণ। সে দেশ থেকে নিয়ে-যাওয়া সম্পদের হিসেব করে এক গবেষক বলেছিলেন, ১৯২০-৩০ সালে কঙ্গোর মানুষ কার্যত নিজেদের আয়ের ৬০ শতাংশ কর দিচ্ছিল। ভারতে নীলচাষিদের উপর অত্যাচারের কথা মনে করলে এর খানিকটা আন্দাজ মেলে। সাধারণত ইউরোপীয়রা কিছু ক্ষমতাশালী স্থানীয় লোকের হাতে কলোনি চালানোর ভার দিত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও ওই সব লোকেরা আগের ব্যবস্থাই চালিয়ে গেল, কারণ সেটাই তাদের কাছে লাভজনক। সিয়েরা লিয়ন, সেনেগাল, কঙ্গো, আফ্রিকার এই সব দেশে বিধিব্যবস্থাগুলো কার্যত আগের মতোই রয়ে গেল, দারিদ্রও ঘুচল না।
তবে কি খারাপ বিধিব্যবস্থা, আর তা থেকে দারিদ্র, এই চক্র থেকে বেরোনোর উপায় নেই? অর্থনীতির দুই অধ্যাপক ডারন অ্যাসেমোলু এবং জেমস রবিনসন মনে করেন, অসম্ভব নয়, তবে কঠিন। সমাজের নানা শক্তি যদি একত্র হয়, আর ভাগ্যও যদি সহায় হয়, তবে হতে পারে। পরিবর্তনের দুটি উদাহরণ তাঁরা দিয়েছেন, ইংল্যান্ডের ‘গৌরবময় বিপ্লব’ আর ফরাসি বিপ্লব। দু’দেশেই বিপ্লবের ফলে রাজার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা খর্ব হয়, নাগরিকের অধিকার বাড়ে। দেশের বিধিব্যবস্থার মোড় ঘুরে যায়। মুশকিল হল, দুটো উদাহরণই কয়েকশো বছর আগের। এমন বিপ্লব আবার কবে হবে, আমাদের কারও জীবদ্দশায় হবে কিনা, তা বলা মুশকিল।
মন্দ বিধিব্যবস্থার বদলানো যে সহজ নয়, তা স্বীকার করেছেন অ্যাসেমোলু আর রবিনসন। তাঁদের চাইতে বেশি আশাবাদী পল কোলিয়র। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের বক্তব্য, চ্যাড, কঙ্গোর মতো গোটা ষাটেক দেশ মন্দ বিধিব্যবস্থার জন্য দারিদ্রের কবলে পড়ে থাকছে। দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছেন একশো কোটিরও বেশি মানুষ। পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোর কর্তব্য সে দেশগুলোর ব্যবস্থাগুলো বদলিয়ে দারিদ্র দূর করা। দরকার হলে সামরিক সাহায্য পাঠিয়ে তা করতে হবে। ব্রিটেন ২০০০ সালে সিয়েরা লিয়নে গৃহযুদ্ধের সময়ে সৈন্য পাঠিয়েছিল বলেই না সে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার টিকে গিয়েছিল।
কিন্তু বাইরে থেকে কি এমন করে পরিবর্তন চাপিয়ে দেওয়া চলে? সে প্রশ্ন তুলেছেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম ইস্টারলি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাইরে থেকে ইরাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েছিল। তার ফল কী ভয়ানক হয়েছিল তা কারও জানতে বাকি নেই। ইস্টারলির আপত্তি, উপর থেকে পরিবর্তন চাপিয়ে দেওয়া হবে কেন? কেন ধরে নেব, একই ছাঁচে পরিবর্তন সবার জন্য কাজ করবে? কিছু ‘এক্সপার্ট’ লোক স্থানীয় পরিস্থিতি অগ্রাহ্য করে বাইরে থেকে সব কিছু বদলে দিতে গেলে তাতে হিতে বিপরীত হবে। সংস্কার যদি হয়, তা হবে ধীরে ধীরে। স্থানীয় মানুষের ভিতর থেকেই তা আসবে।
ইস্টারলি তাই বিদেশি অনুদান দিয়ে দারিদ্র ঘোচানোর ঘোর বিরোধী। কারণ গরিব দেশকে অনুদানের টাকা যে দেয়, সে ওই দেশের রীতিনীতিও বদলানোর চেষ্টা করে। তাঁর মতে, বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষকেই বরং ‘এক্সপার্ট’ বা বিশেষজ্ঞ বলে ধরে নেওয়া হোক, যাঁরা নিজেদের প্রয়োজন মতো নিজেরাই সংস্কার আনবেন। তাঁদের শুধু দরকার রাজনৈতিক স্বাধীনতা, এবং সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, যা দেবে মুক্ত বাজার। দক্ষতার অভাব, পুঁজির অভাবের জন্য গরিবের পক্ষে বাজারে যোগ দেওয়া সহজ নয়। তাদের সেই সক্ষমতা আনতে সরকারি সহায়তা চাই। বাজার যাতে যথার্থই বিঘ্নহীন, পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করতে পারে, তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করাও সরকারের কাজ। ব্যস, ওইটুকুই। আর কোনও বদল চাপানো যাবে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যা কিছু পরিবর্তন, তা উঠে আসবে নীচ থেকে। সকলকে সমান সুযোগ, সমান অধিকার দেওয়ার জন্য প্রচার চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বাইরে থেকে আর কিছু করার নেই।