কিন্তু অস্বস্তি জাগে যখন দেখি যে, আন্দোলনে যার নির্মাণ করা হয়েছিল প্রতীকী অর্থে বা বিদ্রুপের অস্ত্র হিসেবে, মিডিয়া যেন তাকেই হুবহু গ্রহণ করল। তাই বাজারের প্রায়-শূন্য থলি, আর ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে আক্রমণ, এই দুটোই মিডিয়াতে সব কথাবার্তা ছাপিয়ে উঠল। টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখল, চাল-গমের জন্য দিনে সাড়ে পাঁচ টাকা, ডালের জন্য এক টাকা দুই পয়সা কিংবা দুধের জন্য দু’টাকা তেত্রিশ পয়সার বেশি খরচ করলে আপনি দারিদ্রসীমা ছাড়িয়ে যেতে পারেন। গোটা রিপোর্ট (সেপ্টেম্বর ২১, ২০১১) যোজনা কমিশনের হিসেবকে তুলে দিয়েছে, প্রায় কোনও মন্তব্য ছাড়াই, কিন্তু রিপোর্টারদের বক্তব্য স্পষ্ট— দেখে নাও এই হিসেব কতটা আজগুবি। ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকার রিপোর্টার (সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১১) বেঙ্গালুরুর এক বিধবা গৃহস্থালি কর্মীর সাক্ষাৎকার নিলেন, ৩২ টাকায় বাঁচা যায় কি না। সেই মহিলা চোখের জলে ভেসে বললেন, সনিয়া গাঁধী ৩২ টাকায় বেঁচে দেখাক। টাইমস অব ইন্ডিয়া-র সাংবাদিক দিল্লির নানা বস্তির বাসিন্দাদের প্রশ্ন করলেন, দিনে ৩৪ টাকায় বাঁচলে তাকে গরিব বলা ভুল কি না (২১ মার্চ, ২০১২)। আউটলুক (এপ্রিল ২, ২০১২) পত্রিকার সাংবাদিক নিজে ২৮ টাকায় এক দিন বাঁচার চেষ্টা করে দেখলেন। তিন কাপ চা, দু’টুকরো পাঁউরুটি আর এক প্লেট কুলচা-ছোলার বেশি সারা সকাল কিছু খেতে না পেরে ‘অ্যাংরি অ্যান্ড হাংরি’ অবস্থায় দুপুরবেলা রিপোর্ট লিখলেন তিনি।
সরকারি দাবি পরখ করতে সাংবাদিকদের যে ক’টা অস্ত্র রয়েছে, তার মধ্যে একটা অবশ্যই এই অভিজ্ঞতা দিয়ে মিলিয়ে নেওয়ার পদ্ধতি। বন্যায় ত্রাণ সত্যিই গরিব পাচ্ছে কি না, রেশন সত্যিই মিলল কি না, স্কুল-হাসপাতাল খোলা কি না, এ সবই গ্রামে গিয়ে নিজে দেখে, স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে প্রকাশ করলে সরকারি কর্তাদের দাবি কতটা ধোপে টেকে, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উন্নয়নের নানা ‘jargon’ (‘women’s empowerment’, ‘participatory democracy’, ‘community ownership’) বাস্তবে কতটা অর্থপূর্ণ হচ্ছে, তা-ও এ ভাবে স্পষ্ট করে দেওয়া যায়। কিন্তু দারিদ্রসীমার ক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতা, কিংবা গরিবের অভিজ্ঞতা দিয়ে সাংবাদিকরা ঠিক কী চ্যালেঞ্জ করতে চাইছেন, তা হয়তো নিজেদের কাছেই তাঁরা স্পষ্ট করেননি। তাঁরা প্রশ্ন করেননি, যে দৈনিক খরচের অঙ্কে পৌঁছলে বেঙ্গালুরুর গৃহস্থালি কর্মীর (যিনি মাসে পাঁচ হাজার টাকা রোজগার করেন) কিংবা ইংরেজি পত্রিকার সাংবাদিকের (যিনি গৃহস্থালি শ্রমিকের অন্তত দশগুণ রোজগার করেন) অভাবের বোধ থাকবে না, সেই অঙ্কটি কেমন হবে? তাকে দারিদ্রসীমা ধরলে ভারতে প্রায় সব মানুষই কি ‘গরিব’ পর্যায়ভুক্ত হবেন না? আর তা হলে দারিদ্রসীমা তৈরি করারই কি কোনও প্রয়োজন থাকবে?
আউটলুক-এর সাংবাদিক নিজের অর্ধদিন অল্পাহারের পর দাবি করেছেন, দৈনিক ২৮ টাকায় দরিদ্রতম (‘poorest of the poor’) মানুষও বাঁচতে পারে না। খিদের কামড়েই হয়তো খেয়াল করেননি, অন্তত ৩৫-৪০ কোটি এমন মানুষ রয়েছেন এ দেশে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় দারিদ্রসীমার কাছাকাছি মানুষরা কত চাল, ডাল, তেল খান, তার হিসেব স্পষ্টই ধরা রয়েছে। অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেই তথ্য একবার মেলানো হল না কোনও সাংবাদিকের। অথচ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটা অন্য রকম ‘স্টোরি’ সাংবাদিকরা করতে পারতেন। তা হল, বাস্তবিক যাঁরা দারিদ্রসীমার তলায় রয়েছেন তাঁরা কী খেয়ে রয়েছেন, কেমন করে ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন, চিকিৎসা করাচ্ছেন, আমোদ-আহ্লাদও করছেন। দারিদ্রসীমা ২০ টাকা নাকি ২৮ টাকা, নাকি আরও বেশি বা কম, সে-প্রশ্নটার গুরুত্বই নষ্ট হত মানবজীবনের এই বিপুল সংকটের সামনে। দারিদ্রসীমা যে গরিবের সম্পর্কে খুব সামান্যই বলতে পারে, সে-কথাটাই বিপাকে ফেলত সরকারের উন্নয়নের নীতিকে। সংখ্যাটা ফালতু, তা বলার দরকার হত না।
পেটের খিদে, মুখের কথায় একটি সংখ্যাকে বাতিল করার মধ্যে পরিণামচিন্তার অভাব রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে এক ধরনের ঔদ্ধত্য— অর্থনীতিবিদরা দারিদ্র সম্পর্কে কিছুই বোঝেন না, তাঁদের অঙ্ক ভুল, অভিপ্রায় মন্দ। ‘ক্যালাস’ আর ‘ক্রুয়েল’ শব্দ দুটো নানা মিডিয়া রিপোর্টে ঘুরে-ফিরে এসেছে। ‘ট্র্যাজিক জোক’, ‘ক্রুয়েল জোক’ কথাগুলো বারবার ব্যবহার করা হয়েছে, শেষের কথাটা হেডলাইনেও ব্যবহার হয়েছে (ইন্ডিয়া টুডে, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১১)। সেই সঙ্গে দারিদ্রসীমার সামান্যতা নিয়ে বিক্ষুব্ধ বিস্ময় যোজনা কমিশনের প্রতি, এবং সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের প্রতি আক্রমণের চেহারা নিয়েছে। এ বিষয়ে মিডিয়াকে একরকম নেতৃত্ব দিয়েছেন সাংবাদিক পি সাইনাথ। মন্টেক সিংহ আলুওয়ালিয়া বিদেশে ভ্রমণের সময়ে দিনে দু’লক্ষ টাকা খরচ করেন, ইউ পি এ সরকারের মন্ত্রীরা নিজেদের সম্পদ বিপুল হারে বাড়াচ্ছেন প্রতি বছর, এই তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর বক্তব্য, যাঁরা নিজেরা বিপুল বিলাসিতায় রয়েছেন তাঁরাই দেশবাসীকে দৈনিক ২৩ টাকায় জীবন চালাতে বলছেন (দি হিন্দু, ২১ মে, ২০১২)। অর্থাৎ মন্ত্রী-আমলাদের দুর্নীতির সীমা নেই বলে তাদের প্রস্তাবিত দারিদ্রসীমাও বাতিল করতে হবে। নানা দৈনিক, সাময়িকীর পাতায় সাংবাদিকরা দাবি করলেন যে দরিদ্রের সংখ্যা কম দেখাতে, দরিদ্রের জন্য বরাদ্দ কমাতে যোজনা কমিশন ‘তেণ্ডুলকর পদ্ধতি’ কাজে লাগিয়ে দারিদ্রসীমা তৈরি করেছে। সুরেশ তেণ্ডুলকর মানুষটি কে, কী তাঁর জীবনের কাজ, তা না জেনেই তাঁকে প্রায় ষড়যন্ত্রকারীর পর্যায়ে ফেলা হল।