এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে। যোজনা কমিশনের নির্ধারিত দারিদ্রসীমা ঠিক কিনা, সেটা এখানে আলোচনার বিষয় নয়। সাংবাদিকরা, বা রাজনৈতিক বিরোধীরা যে সরকারকে বা যোজনা কমিশনকে সমালোচনা করবে, সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু কমিশনের বক্তব্য কী, আর জনসমাজের আলোচনায় সে-সম্পর্কে কী বলা হল, তা মিলিয়ে দেখা দরকার।
আলোচনার গোড়ায় দারিদ্রসীমা সম্পর্কিত ঘটনাপঞ্জি দেওয়া দরকার।
২০১১, ২৯ মার্চ: খাদ্যের অধিকারের বিষয়ে পিপলস ইউনিয়ন অব সিভিল লিবার্টিজ (PUCL) ২০০১ সালে সুপ্রিম কোর্টে যে-মামলা করেছিল, তারই সূত্রে সুপ্রিম কোর্ট যোজনা কমিশনের কাছে জানতে চায়, ভারতে অপুষ্টির হার খুবই বেশি, কিন্তু যাঁরা স্বল্পমূল্যে রেশন থেকে চাল-গম পেতে পারেন, সেই গরিবদের সংখ্যা কেন সর্বোচ্চ জনসংখ্যার ৩৭.২ শতাংশ বেঁধে রাখা হয়েছে?
১০ মে: তার উত্তরে হলফনামায় যোজনা কমিশন জানায়, সুরেশ তেণ্ডুলকর কমিটি ২০০৯ সালে যে পদ্ধতিতে দারিদ্রসীমা নির্ণয়ের প্রস্তাব করেছিল, যোজনা কমিশন সেটাই মেনে নিয়েছে। ২০০৪-০৫ সালে দারিদ্রসীমা ছিল দৈনিক ভোগ ব্যয় (consumer expenditure) মাথাপিছু শহরে ২০ টাকা এবং গ্রামে ১৫ টাকা। সেই অনুসারে অঙ্ক কষলে দেখা যাচ্ছে, জনসংখ্যার ৩৭.২ শতাংশ গরিব। এই দারিদ্রসীমায় বা তার উপরে যাঁরা রয়েছেন, আন্তর্জাতিক খাদ্য সংস্থা FAO-র বিধি অনুসারে তাঁদের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরির ঘাটতি হবার কথা নয়।
১৪ মে, ২২ জুলাই: হলফনামা পেশ করার তিন দিন পরে সুপ্রিম কোর্ট বলে, ২০০৪-০৫ সালের দরদাম অনুসারে নির্দিষ্ট দৈনিক ২০ টাকা বা ১৫ টাকায় ২০১১ সালে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সম্ভব নয়। যোজনা কমিশনকে ২০১১ সালের দরদাম অনুসারে মাথাপিছু প্রয়োজনীয় টাকার অঙ্ক নির্দিষ্ট করতে হবে। আবার ২২ জুলাই একটি নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট বলে, ২০০৪-০৫ সালে দারিদ্রসীমা হিসেবে নির্দিষ্ট মাসিক ভোগ ব্যয় (শহরে ৫৭৯ টাকা, গ্রামে ৪৪৭ টাকা) ২০১১ সালের দরদাম অনুসারে নির্দিষ্ট করতে হবে।
২০ সেপ্টেম্বর: যোজনা কমিশন সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিল। কমিশন হিসেব কষল, ২০০৪-০৫ সালের দারিদ্রসীমা মূল্যস্ফীতির পর ২০১১ সালে কত হওয়া উচিত। সেই অনুসারে বলা হল, পাঁচজনের পরিবারের জন্য প্রতি মাসে শহরে ৪৮২৪ এবং গ্রামে ৩৯০৫ দারিদ্রসীমা বলে মানতে হবে। মাথাপিছু হিসেব করলে শহরে তা দাঁড়ায় ৩২ টাকা এবং গ্রামে ২৬ টাকা। এত কম টাকা খরচ করে কেউ দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে পারে কি না, এই প্রশ্নে ঝড় উঠল মিডিয়াতে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ৩ অক্টোবর প্রেস কনফারেন্স করলেন মন্টেক সিংহ আলুওয়ালিয়া, তাতে সমালোচনার ধার কমল না।
২০১২, ১৯ মার্চ: নতুন হলফনামা পেশ করল কমিশন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে কোর্টে হলফনামা দেওয়ার সময়ে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ২০০৯-১০ সালের পারিবারিক ভোগ ব্যয় সমীক্ষার ফল হাতে আসেনি। ২০১২ সালে সেই তথ্য-পরিসংখ্যান হাতে এসে যাওয়ায় তার ভিত্তিতে অঙ্ক কষে দেখা গেল, ২০০৪-০৫ সালের দারিদ্রসীমা ২০০৯-১০ সালে দাঁড়িয়েছে দৈনিক মাথাপিছু শহরে ২৮ টাকা ৬৫ পয়সা, গ্রামে ২২ টাকা ৪৩ পয়সা। এই অঙ্ক অনুসারে ভারতে গরিবের অনুপাত ৩৭.২ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২৯.৮ শতাংশে। সংখ্যার হিসেবে গরিব মানুষ ৪০.৭ কোটি থেকে ৩৫.৫ কোটিতে নেমে এসেছে। এই হলফনামা দেওয়ার দু’দিন পরেই (২১ মার্চ) লোকসভায় প্রায় সব দলের নেতারা যোজনা কমিশনকে তুলোধোনা করে এই দারিদ্রসীমাকে উড়িয়ে দিলেন।
২৪ মে: প্রবল সমালোচনার মুখে নতুন একটি বিশেষজ্ঞ দল তৈরি করা হল অর্থনীতিবিদ সি রঙ্গরাজনের নেতৃত্বে। কমিটি দারিদ্রসীমা নির্ণয় করার পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করছে।
‘নিষ্ঠুর রসিকতা’: দারিদ্র ও মিডিয়া
ইংরেজি কাগজগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, একটি সংখ্যাকেই দারিদ্রসীমার আলোচনার কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। তা হল মাথাপিছু দৈনিক ব্যয়। ‘দিনে ৩২ টাকায় কী হয়?’ সুপ্রিম কোর্টের কাছে কমিশনের সেপ্টেম্বরের হলফনামার পর এই ছিল মিডিয়ার সমালোচনার মূল সুর। কখনও অবিশ্বাস, কখনও ক্ষোভ, কখনও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মধ্যে দিয়ে এই কথাটিই ঘুরে-ফিরে এসেছে। বত্রিশ টাকা ঠিক কীসের মাপ, সেটাও গুলিয়ে যেতে লাগল। হিন্দুস্তান টাইমস হেডলাইনে লিখল, ‘যোজনা কমিশনের রসিকতা: দিনে ৩১ টাকা পাঁচজনের পরিবারের জন্য যথেষ্ট।’ যদিও দিনে ৩১ টাকা ছিল মাথাপিছু হিসেব, পরিবারের জন্য নয়। টাইমস অব ইন্ডিয়ার হেডলাইন, ‘দিনে ৩২ টাকা খরচ করেন? সরকারের মতে আপনি গরিব নন।’ আউটলুক পত্রিকায় শিরোনাম, ‘কম, আরও কম।’ টেলিভিশন চ্যানেলগুলি দেখাতে লাগল, ৩২ টাকায় (মার্চের হলফনামার পর, ২৮ টাকায়) বাজার থেকে কী কী খাবার কেনা সম্ভব, তাতে কী করে পেট চালানো যেতে পারে।
মিডিয়াতে এই সমালোচনা হয়তো আকস্মিক নয়, নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে এর একটা ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়। যাঁদের আবেদনের ভিত্তিতে এই মামলা এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়, সেই PUCL সদস্যরা যোজনা কমিশনের প্রথম হলফনামার পর দারিদ্রসীমার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে যোজনা কমিশনের প্রত্যেক সদস্যের নাম করে ২০ টাকার বাজার করে এনেছিলেন। এই বিক্ষোভের ধরনের দু’টি দিক আছে— এক, বক্তব্যের ভাল-মন্দের আলোচনায় না গিয়ে বক্তাকে দোষী ঠাহর করে ব্যক্তিগত আক্রমণ। এবং দুই, বক্তব্যকে বিদ্রুপ করে তাকে ভুল প্রতিপন্ন করার চেষ্টা। ভাবটা এই যে, যদি দেখিয়েই দেওয়া যায় যে ২০ টাকায় হাফ কেজি আলু, চারটে পটল ছাড়া কিছু হয় না, আর তা দিয়ে কারও পেট ভরা সম্ভব নয়, তা হলে আর বলার থাকেটা কী? নাগরিক আন্দোলনের শরিকদের কাছে অবশ্য এই ধরনের স্ট্র্যাটেজি খুব অপ্রত্যাশিত নয়, হয়তো অনভিপ্রেতও নয়। যেখানে কোনও সরকারি নীতি বা গাফিলতির বিরুদ্ধে জনমত তৈরির চেষ্টা হয়, সেখানে বিমূর্ত নীতিকে প্রত্যক্ষ চেহারা দেবার একটা তাগিদ থাকে। তাই ‘মৃত’ টেলিফোনের ‘শবযাত্রা’ বার করা হয়, কিংবা ক্রেতা সুরক্ষা আইনে চিকিৎসকদের আনার প্রতিবাদে ডাক্তাররা আলু-পটল বেচেন।