দারিদ্রসীমা একটি সংখ্যা। উন্নয়ন সম্পর্কিত এমন নানা সংখ্যা অঙ্ক কষে বের করা অর্থনীতির বিশেষজ্ঞদের কাজ। সেই সংখ্যাকে মর্যাদা দেওয়া মানে, সংখ্যা যাঁরা তৈরি করছেন তাঁদের পেশাদারিত্ব স্বীকার করা। তাঁদের মতামত যা-ই হোক না কেন, যে-প্রশ্নটা তাঁদের করা হয়েছে (যেমন, ভারতে কত গরিব মানুষ আছে?) সেটার নৈর্ব্যক্তিক উত্তর দেওয়াটা যে তাঁদের কাজ, এবং সেই কাজ যে তাঁরা সততার সঙ্গে করছেন, এটা মেনে নেওয়া। অর্থনীতির জগতে সদ্য প্রয়াত সুরেশ তেণ্ডুলকরকে সেই মর্যাদা দেওয়া হত। টি এন শ্রীনিবাসনকে সেই মর্যাদা দেওয়া হয়। এঁদের মতামতের সঙ্গে যাঁদের মতের অমিল রয়েছে, তাঁরাও এঁদের সততা বা সামর্থ্যকে সন্দেহ করেন না। এই ট্র্যাডিশনই এ দেশে তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু গত বছর দারিদ্র নিয়ে দেশে বিতর্ক-বিক্ষোভের যে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল, তাতে মনে হচ্ছে সেই ঐতিহ্য যেন আমরা হারাতে বসেছি। বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল কয়েকটি সংখ্যা। ভারতে গরিব মানুষ কত শতাংশ, তা ছিল একটা সংখ্যা। আর দুটো সংখ্যা ছিল দৈনিক খরচের। শহরে আর গ্রামে সর্বোচ্চ কত টাকা ব্যয় করলে তাকে গরিব বলা চলে, সেই টাকার অঙ্ক। এই সংখ্যাগুলো কী করে পাওয়া গেল, কী উদ্দেশ্যে এগুলো কষে বার করা হল, কোন দুঃসাহসে এগুলো আনা হল জনসমক্ষে, এমন সব প্রশ্ন তুলে যে হইচইটা বেধে গেল, তাতে বন্যার বছরে ক্ষতিপূরণের টাকার অঙ্ক, কিংবা নির্বাচনের বছরে ঋণ মকুবের টাকার অঙ্ক ঠিক করার সঙ্গে দরিদ্রের ন্যূনতম মাসিক খরচের টাকার অঙ্ক ঠিক করার কোনও তফাত রইল না। যেন কেউ খেয়ালই করলেন না যে, রাজনীতির অঙ্ক কষার সঙ্গে অর্থনীতির অঙ্ক কষার কোনও তফাত রয়েছে।
এই গোলমালে মিডিয়া, নাগরিক সমাজ আর রাজনীতির নেতারা প্রায় সকলেই দাঁড়ালেন যোজনা কমিশনের বিরুদ্ধে। এমনকী কংগ্রেসেরও দু’-চার জন মন্ত্রী মুখরক্ষার মতো কয়েকটা কথা বলে চুপ করে গেলেন। কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী, জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি মনমোহন সিংহ নিজে মিডিয়ার কাছে, সংসদে কিংবা জনসভায় দারিদ্রসীমার সপক্ষে একটি কথাও বললেন না। কংগ্রেসের শরিক দলগুলোও সংসদে দারিদ্রসীমাকে আক্রমণ করল, বিরোধীরা তো বটেই। ফলে ‘বাইট’ যাঁরা দিলেন, আর যাঁরা নিলেন, তাঁরা প্রায় সকলে দাঁড়ালেন এক দিকে। অন্য দিকের মুখপাত্র বলতে যোজনা কমিশনের ডেপুটি কমিশনার মন্টেক সিংহ আলুওয়ালিয়া, যাঁর গ্রহণযোগ্যতা মিডিয়া কিংবা সাধারণ নাগরিকের চোখে কখনওই খুব উঁচু মাপের ছিল না। যোজনা কমিশনের অন্য দু’চারজন কর্তার বক্তব্য উদ্ধৃত হল মিডিয়াতে, তাঁরাও কেউ খুব পরিচিত ব্যক্তি নন। দারিদ্রসীমার সমর্থনে দু’চারজন যাঁরা কলম ধরলেন ইংরেজি পত্রপত্রিকাতে, তাঁরা পেশাদার অর্থনীতিবিদ। অধিকাংশই খোলা বাজারের সমর্থক বলে চিহ্নিত। ইংরেজি কাগজে তাঁদের নিবন্ধগুলো ‘পাবলিক’ খেয়ালও করল না। যোজনা কমিশনের প্রস্তাবিত দারিদ্রসীমা বাতিল হল, নতুন বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি হল, আর এক দফা সমীক্ষার পরে (আর্থ-সামাজিক ও বর্ণ সমীক্ষা) নতুন দারিদ্রসীমা ঠিক হবে বলে রফা হয়েছে। সেই সমীক্ষা এখনও চলছে। কে গরিব, তা ঠিক করার কোনও মাপকাঠি দেশের কর্তাদের হাতে এই মুহূর্তে নেই।
এই গোটা ঘটনা থেকে কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসে। এক, বড় মিডিয়া সংস্থাগুলি প্রায় সব ক’টিই কেন দারিদ্রসীমার ধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়াল? এদের মধ্যে অধিকাংশই মূলস্রোতের অর্থনীতির সমর্থক, উন্নয়নের যে ধারণায় দারিদ্র কমানোর পরিকল্পনা করা হয়, তার সঙ্গে টাইমস অব ইন্ডিয়া কিংবা ইন্ডিয়া টুডে কাগজের নীতিগত বিরোধ নেই। দারিদ্রসীমার ধারণা উন্নয়নের সেই মূলস্রোতের নকশার বিরোধী নয়। দারিদ্রসীমা মিডিয়ার কাছে নতুন কোনও ধারণাও নয়, যে ভাবে যোজনা কমিশন তা নির্ধারণ করেছে সেই পদ্ধতিতেও খুব নতুনত্ব কিছু নেই। তা হলে প্রায় গোটা মিডিয়া যোজনা কমিশনের ঘোষিত দারিদ্রসীমার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর তাগিদ অনুভব করল কেন?
দুই, রাজনীতির নেতারা প্রায় সকলেই এর বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, কিংবা নীরব থাকলেন। কেন? দারিদ্রসীমা প্রয়োগ করলে গরিব রাজ্যগুলো অনেক বেশি টাকা পেত তুলনায় ধনী রাজ্যের চাইতে, কারণ এই সূচক অনুসারে ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, বিহার, অসমের মতো রাজ্যে গরিবের সংখ্যা বেশি থাকত। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বহু দিন ধরে বিহারে দারিদ্র বেশি, এই যুক্তি দেখিয়ে বেশি টাকা দাবি করে আসছেন কেন্দ্রের থেকে। অথচ তাঁর দলের সাংসদ শারদ যাদব দারিদ্রসীমার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করলেন সংসদে। বেশি টাকা পাওয়ার চাইতে চিরাচরিত রাজনৈতিক বিরোধিতাই কি তাঁদের কাছে বেশি প্রয়োজনীয় ছিল? নাকি দারিদ্রসীমা সমর্থন করা মানে দরিদ্রকে অসম্মান করা, এমন কোনও ধারণা চাউর হয়ে যাওয়ায় দারিদ্রসীমাকে সমর্থন করা তাঁদের কাছে রাজনৈতিক ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল?
আর তিন, এই বিতর্ক (নাকি বিতর্কের অভাব?) থেকে দারিদ্র নিয়ে জনসমাজে (public sphere) আলাপ-আলোচনার ধরনধারণ সম্পর্কে কী ছবি স্পষ্ট হল? কী ভাবে ভারতে নীতি বিষয়ক আলোচনার গতিপ্রকৃতি নির্দিষ্ট হয়? তা থেকে আমাদের জনসমাজে, বিশেষত মিডিয়াতে, ডিসকোর্স সম্পর্কে কী বোঝা যায়?