এর প্রতিটিকেই মস্ত সাফল্য বলে স্বীকৃতি দিতে হবে। বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, রাজনৈতিক যোগদান, এমন সব বিষয় নিয়ে বহু সহস্র বছরের ধারণা আমূল বদলে গিয়েছে মাত্র কয়েক দশকে। এমনকী অর্থনৈতিক পরিবর্তন যা ঘটেছে, তারও নজির নেই ইতিহাসে। আমার নিজের (অপেশাদার) ইতিহাস পাঠ থেকে মনে হয়েছে, যদিও গরিবের জীবনযাত্রার মানে এর আগেও নানা হেরফের হয়েছে, কিন্তু গত ৩০ বছরে দারিদ্র যত কমেছে তেমন অতীতে কখনও হয়নি।
কিন্তু আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, হয়তো এই উন্নতি ধরে রাখা যাবে না। এমন এক সংকট আসবে, যা উন্নয়নের সব লাভ ধুয়েমুছে দিয়ে ক্ষতির পাল্লা ভারী করবে। সম্প্রতি সাক্ষ্য মিলেছে যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রায় দুই ডিগ্রি বৃদ্ধি ঘটেছে। যে আশঙ্কা বিজ্ঞানীরা এতদিন করছিলেন, তা আর এড়ানো যাবে না। এখন আমরা চার ডিগ্রি বৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়ে খেলা করছি, যা প্রায় নিশ্চিতভাবে এক ভয়ঙ্কর পরিণাম তৈরি করবে। অতিবৃষ্টি, জলস্ফীতি, বন্যার ধ্বংসলীলায় প্রায় অকল্পনীয় প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষতি হবে, বলছেন বিজ্ঞানীরা।
কিন্তু উন্নয়ন চাওয়া মানেই কি এমন ধ্বংসকে ডেকে আনা? যে সব উন্নয়নের খতিয়ান এতক্ষণ দিচ্ছিলাম, মহাপ্লাবন কিংবা প্রবল খরা কি তার অপরিহার্য পরিণতি? অনেকেই ভোগের তাগিদ-চালিত উন্নয়নকে পরিবেশের ভারসাম্যের বিরোধী বলে মনে করেন। সেটা নিয়ে একটু প্রশ্ন থাকে। এই নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে সমাজ-অর্থনীতিতে পরিবর্তন ও উন্নয়নের যে সব দৃষ্টান্ত, তার অনেকগুলির ক্ষেত্রেই এ যুক্তি চলে না। যে দলিত-আদিবাসীরা নিজেদের মর্যাদা ও অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন, যে-মেয়েরা ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন করেন, যাঁরা বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের ভোগবাদ ও তজ্জনিত পরিবেশ ধ্বংসের জন্য দায়ী করা কখনওই চলে না। আবার জনস্বাস্থ্যে, চিকিৎসায় যে উন্নতি হয়েছে, তা পাশ্চাত্যে দ্রুত নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে মহামারি ছড়ানোর ভয়, যুদ্ধে জেতার আগে অসুখে সৈন্য মারা যাওয়ার ভয় থেকেও হয়েছে। সেই সঙ্গে বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য রোগকে আরও ভাল বুঝতে পারার ক্ষমতাও তৈরি হয়েছে। তা হলে ভোগবাদ-তাড়িত হয়েই উন্নয়ন হয়, তাই উন্নয়নকে সমর্থন করা মানেই পরিবেশের সর্বনাশ ডেকে নেওয়া, তা বলি কী করে? এক কথায়, দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে বাধ্য, তা আমি বিশ্বাস করি না।
আসল সমস্যা হল, এখন উন্নয়নের যে মডেলগুলো আমাদের হাতের কাছে রয়েছে, সেগুলো যে সময়ে তৈরি হয়েছিল তখন পুঁজিবাদী, মার্ক্সবাদী, কেউই প্রকৃতির প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না। এখনকার জীবনযাত্রায় মানুষ অভ্যস্ত হয়ে ওঠার আগে যদি আমরা পরিবেশের সংকট বিষয়ে জানতাম, এবং সেই অনুসারে কাজ করতাম, তা হলে হয়তো আজ জীবনটাই অন্য রকম হত। তার মানে এই নয় যে, জীবনে দারিদ্র আরও বেশি থাকত। এ কথাটা মনে রাখা জরুরি, কারণ আমরা যদি মনে করি, কোনও একটা বিকল্প অর্থনীতির মডেলের বিষয়ে সকলে সহমত না হলে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করা যাবে না, সেটা মস্ত ভুল হবে।
যদি নিজেদের বাঁচাবার সুযোগ পেতে হয়, তা হলে আমাদের এখনই কাজে নামতে হবে, এবং তা সকলকে নিয়ে। আর তা করতে হলে আমাদের আজকের সংকট, আজকের সমস্যা নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। গত ৯০ বছরে আমার যা করতে পেরেছি, তার সাফল্য উদযাপন করতে হবে। আর্থিক মন্দা, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, আরও যা যা ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো মাথায় রেখেও উদযাপন করতে হবে। কারণ, সাফল্যের সম্পদ থেকে সাহস সঞ্চয় না করলে ত্যাগ স্বীকার করা কঠিন।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩
দরিদ্রের সংখ্যা, সংখ্যার দারিদ্র
২০১১ সালে যোজনা কমিশন দারিদ্রসীমা ধার্য করে, পাঁচজনের পরিবারের জন্য মাসে ৪৮২৪ টাকা শহরে, আর ৩৯০৫ টাকা গ্রামে। বেশ কিছু সামাজিক সংগঠন এবং সংবাদমাধ্যম আপত্তি তোলে যে, মাথাপিছু দৈনিক ৩২ টাকায় শহরে জীবনধারণ সম্ভব নয়।
সংখ্যার সম্মান কি আমরা ভুলতে বসেছি? গত এক বছরে দারিদ্রসীমা নিয়ে জনসমাজে যে বিতর্ক হল, তাতে মনে হয় উন্নয়নে সংখ্যার প্রয়োজন কী, প্রয়োজন কেন, তার ধারণা আবছা হয়ে এসেছে। অথচ এই ভারতেই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের নেতৃত্বে তাঁর ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের কর্মীরা বিশ্বের প্রথম বৃহৎ মাপের সমীক্ষা করেছিলেন। তা থেকেই শুরু হয় জাতীয় নমুনা সমীক্ষা। এই সমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্যের কিছু কিছু অংশ ব্যবহার করে বার করা হয়েছিল, দেশে কত গরিব মানুষ আছে। দারিদ্রসীমা নির্দিষ্ট করার কাজেও ভারতই প্রথম ছিল। যোজনা কমিশনের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ ১৯৬০-৬১ সালের বাজারদরে মাসে ২০ টাকা ব্যয় ক্ষমতাকে ‘দারিদ্রসীমা’ বলে নির্দিষ্ট করেন। বাঁচার জন্য যে পুষ্টি প্রয়োজন তার জন্য কত খরচ না করলেই নয়, এবং আরও দু-চারটি বিষয়ের হিসেবের ভিত্তিতে, যথেষ্ট চিন্তা আর পরিশ্রম করে তাঁরা এই সীমা নির্দিষ্ট করেছিলেন ১৯৬২ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দারিদ্রসীমা তৈরি করেছিল এর তিন বছর পর, ১৯৬৫ সালে।