অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ২৭ অক্টোবর ২০১৪
সম্পদ ও সংকট
নব্বই বছর আগে বিশ্বের গড়পড়তা মানুষের জীবন যেমন ছিল, আজ তার চাইতে অনেক ভাল। সত্যি বলতে কী, তার আগে যে-কোনও সময়ের চাইতে আজ সাধারণ মানুষ ভাল আছে। এই ১৯৫৫ সালেও বিশ্বে গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪৮ বছর (ওই বছর থেকেই গোটা বিশ্বের তথ্য দিতে শুরু করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। পেনিসিলিনের মতো শক্তিশালী ওষুধ ব্যাপক হারে ব্যবহারের পরেও এই ছবি ছিল। সুতরাং ১৯২৩ সালে আয়ু আরও কম ছিল নিশ্চয়ই। এখন গড় আয়ু ৭০ বছরের কাছাকাছি। ১৯৫৫ সালে প্রতি সাতজন শিশুর একজন এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যেত। এখন মারা যায় তার এক-তৃতীয়াংশ।
কেবল স্বাস্থ্যই নয়। ১৯৫০ সালেও বিশ্বের ৪৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিরক্ষর ছিলেন। এখন সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ শতাংশে। যাঁরা তীব্র দারিদ্রে বাস করেন, ১৯৮১ থেকে আজকের মধ্যে তাঁদের অনুপাত ৫০ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
উন্নয়নের এই কাহিনি কেবল চিন আর পূর্ব এশিয়ার নয়। ভারতের মতো দেশেও ১৯২০-র দশকে গড় আয়ু ছিল মাত্র ২৭ বছর। এখন তা ৬৬ বছর। আফ্রিকাতে ১৯৫০-এর দশকে ৩৮ বছর আয়ু থেকে এখন ৫৫ বছরে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার সময়েও ভারতে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল ২০ শতাংশ। এখন তা ৭৫ শতাংশ। ভারতের জাতীয় দারিদ্রসীমা (যা বিশ্বব্যাঙ্ক নির্ধারিত দারিদ্রসীমার খুবই কাছাকাছি) অনুসারে এখন ২২ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। ১৯৪০-এর দশকের কিছু কিছু এমন হিসেব দেখেছি, যা অনুসরণ করলে দারিদ্রের অনুপাত দাঁড়ায় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি।
কিন্তু সম্ভবত যা আরও বেশি বদলে গিয়েছে, তা হল আমাদের বিশ্বকে দেখার চোখ। ১৯২৩ সালে সব জায়গায় আধিপত্য ছিল সাদা লোকেদের— অন্তত যদি জাপানিদের শ্বেতাঙ্গ বলে ধরা হয়, যেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে জাপানে, পাশ্চাত্যেও। যেখানে তাঁরা সরাসরি শাসন করেনি, সেখানেও তাঁরাই বিধিব্যবস্থা ঠিক করত। বেশির ভাগ মানুষ মনে করতেন, এমনই হওয়ার কথা। ১৯২৬ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে স্বরাজ চেয়েছিল, কয়েক দশক আগেই যা দেওয়া হয়ে গিয়েছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়াকে, তখন ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য স্পেকটেটর’ সেই দাবিকে বলেছিল ‘পাগলের পরিকল্পনা’।
১৯৩১ সালের গোলটেবিল বৈঠকে গাঁধী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে সমানে সমানে দরদস্তুর করছেন দেখে চার্চিল এমনই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তিনি গাঁধীকে ‘অর্ধনগ্ন’, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী ফকির’ বলেছিলেন। আজকের দুনিয়াতেও যে কিছু কিছু দেশ মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব খাটাচ্ছে না, তা নয়। তবে সেটা তাদের অর্থনীতির জোরে, সামরিক জোরে, কিংবা অনুদানের টাকার জোরে। উন্নততর সভ্যতার দাবির জোরে নয়। আর ওই সব দেশও ভালই জানে, চিন, ব্রাজিল, কিংবা হয়তো ভারত তাদের জায়গায় চলে আসা কেবল সময়ের অপেক্ষা।
আরও নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে চলেছে দেশের অভ্যন্তরে। ১৯২৩ সালেও অম্বেডকর দলিতদের নেতা হয়ে ওঠেননি। আরও পরে তিনি গাঁধী ও কংগ্রেসের সংশ্রব ত্যাগ করবেন, কারণ ‘তাঁর লোকেদের’ জন্য কংগ্রেস কিছু করতে পারবে, সে-আস্থা তাঁর ছিল না। পরে দেখা গেল, যে সব দলে উচ্চবর্ণের নেতৃত্ব, সেগুলোই জাতীয় রাজনীতিতে আধিপত্য জারি রাখলেও, পরিবর্তন এল দলিতদের জীবনেও। নিঃসন্দেহে অম্বেডকরের নিজের তৈরি করা নীতির জন্যেও তা সম্ভব হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে তফশিলি জাতি, জনজাতির মানুষ অন্যদের চাইতে ৩৬ শতাংশ কম রোজগার করতেন। ২০০৪-০৫ সালে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায় দেখা গেল, ওই ফারাক প্রায় অর্ধেক কমে গিয়েছে। তাঁদের যুক্তি ছিল, শিক্ষায় (কত বছর স্কুলে পড়ছে, তার হিসেবে) দলিত-জনজাতির মানুষ অন্যদের কাছাকাছি চলে আসা এই ফারাক কমার অন্যতম কারণ। ভুলে যাওয়া চলে না, ওই ১৯২৩ সালেই মুম্বইয়ের সিডেনহ্যাম কলেজের অধ্যাপকরা আন্দোলন করেছিলেন অম্বেডকরকে কলেজ থেকে বরখাস্ত করার দাবিতে, যে হেতু বর্ণপ্রথা অনুসারে অম্বেডকরের কাছাকাছি যাওয়াই নিষিদ্ধ ছিল তাঁদের জন্য। আজ এ দেশের স্কুলের ক্লাসঘরে সব জাতের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বসে খাবার খায়।
এমন পরিবর্তন গোটা বিশ্বেই ঘটছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিম ক্রো আইন কার্যকর ছিল ১৯২৩ সালেও। ওই আইন সাদা লোকের ‘সুরক্ষা’ দিত কালো লোকেদের থেকে, তাদের সঙ্গে বাসে-ট্রামে, স্টেশনে-ক্লাবঘরে এক জায়গায় বসার থেকে। ২০১৩ সালে এসে দেখা যাচ্ছে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তাঁর আগে, বুশ প্রশাসনে প্রেসিডেন্টের ঠিক পরের পদটি ছিল কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা কন্ডোলিজা রাইসের। ১৯২০ সাল অবধি কোনও মহিলাই আমেরিকায় ভোট দিতে পারত না, কৃষ্ণাঙ্গ তো দূর অস্ত্। ফ্রান্সে ১৯৪৪ সাল অবধি মেয়েদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ভোট দেওয়ার জন্য।
সত্যি বলতে কী, মানুষের ভোটে না জিতলে সরকার তৈরি করা যাবে না, এই ধারণাটাই খুব পুরনো নয়। ১৯২৩ সালে হিটলার আর তাঁর সঙ্গী গুন্ডারা বাভারিয়ার নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিল (তখনকার মতো)। বামপন্থী আর দক্ষিণপন্থী, দু’তরফেই তখন এই ধারণাটাই ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে যে রাষ্ট্রকে হতে হবে সর্বশক্তিমান, আর তা চালানোর দায়িত্বে থাকতে হবে এমন কোনও অভিজাত নেতাকে যিনি ‘বোঝেন’ কী ভাবে দুনিয়াটা চলছে। ১৯২৩ সালে লেনিন ক্ষমতা দখলের দিকে এগিয়ে চলেছেন, মুসোলিনি নিজেকে ১৯২৫ সালে একনায়কতন্ত্রের শাসক বলে ঘোষণা করবেন, হিটলার করবেন ১৯৩৩ সালে। এ সবের জন্য বিশ্ব যতই যন্ত্রণাদীর্ণ হোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও প্রায় ৫০ বছর কেটে গেল গোটা বিশ্বের মানুষের, সেই সব ‘মহান নেতা’-র উপর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে, যাঁদের বুকে প্রায়ই গাদাগুচ্ছের মেডেল সাঁটা থাকত, যাঁরা নির্বাচন নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন না। আজকের বিশ্ব আগেকার চাইতে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক।