এ দেশে যা কিছু গোলমাল, তার দায় জাতপাত ব্যবস্থা আর ব্রিটিশ শাসনের ঘাড়ে চাপানোই দস্তুর। দুঃখের বিষয়, আমিও এ ক্ষেত্রে তা-ই করব। যাঁরা গতর খাটিয়ে কাজ করেন, কয়েক হাজার বছর ধরে তাঁদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে। মাত্র কয়েক প্রজন্মে এই মনোভাব দূর করা সহজ নয়। হাতের কাজকে অশ্রদ্ধার নিয়ম, আর সেই নিয়ম চাপানোর জন্য গায়ের জোর, এ দুটোই হয়তো আজ আর আগের মতো অত জোরদার নেই। কিন্তু সেই সংস্কৃতির ছাপ রয়েই গিয়েছে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে (না হলে আমিই বা অধ্যাপক হলাম কেন?)। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এই সব আকাঙ্ক্ষায় দাগ বুলিয়ে চলেছে। ব্রিটিশরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল অল্প কিছু কেরানি নিয়োগ করার তাগিদে। তারা এমন লোক চেয়েছিল যারা পরীক্ষায় পাশ করতে ওস্তাদ, প্রশ্ন করলে ইংরেজিতে উত্তর দিতে পারবে, আর অন্য সময়ে মুখ বন্ধ রাখবে। এখনও শিক্ষাব্যবস্থা সেই উদ্দেশেই কাজ করে চলেছে— অন্তত আমি যখন স্কুলের ছাত্র ছিলাম, তখনও করত (সেটা যদিও বেশ কিছুদিন আগে, কিন্তু অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া স্কুল সহজে বদলায় না)। আমরা পড়াশোনায় যথেষ্ট ভাল না করলে, বা আচরণ যথেষ্ট সুবোধ না হলে, আমাদের শিক্ষকরা আমাদের সবার সামনে অপদস্থ করার জন্য বলতেন, স্কুল থেকে আধ কিলোমিটার দূরের ওই আইটিআইতে পড়া লেখা রয়েছে আমাদের কপালে। এরপর আর কে সেখানে পড়তে চাইবে?
হয়তো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজের জীবন থেকে এই বিশ্বাস পেয়েছেন যে কঠোর শারীরিক পরিশ্রম দিয়ে সব খামতি, সব বাধা, জয় করা যায়। যদি তাই হয়, তা হলে বলতে হবে যে আমরা, ভারতের অধিকাংশ মানুষ, তাঁর সেই বিশ্বাসের অংশীদার নই। আমরা বরং বারবার চাকরির পরীক্ষায় বসব, বা একটার পর একটা কোর্স করব, এই আশায় যে-কোনও মতে একবার একটা চেয়ার-টেবিলে বসার চাকরি মিলে যাবে। বা অন্তত যে দিন মেনে নিতে হবে যে তেমন চাকরি আর পাব না, সে-দিনটা একটু দূরে ঠেলা যাবে।
সমস্যা হল, ভারতকে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’ বা উৎপাদনের কেন্দ্র করে তোলার যে স্বপ্ন মোদী দেখছেন, আমাদের শ্রম-বিমুখতা তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যদি কায়িক পরিশ্রমের কাজ মানুষ করতে না চায়, তা হলে মজুরির হার চড়া থাকবে। ফলে প্রতিযোগিতায় আমরা তেমন এগোতে পারব না।
এ ব্যাপারে কী করা যেতে পারে? প্রথমত, আমরা আমাদের চাহিদায়, পছন্দে, পরিবর্তন আনতে পারি। কেবল মোদীই নয়, তরুণ প্রজন্ম যাঁদের পছন্দ করে সেই সব মানুষদের শ্রমের পক্ষে সওয়াল করতে হবে। যদি ক্রিকেট ছেড়ে হকি নিয়ে বলিউডের ছবি হতে পারে, তা হলে সততা, কঠোর পরিশ্রমের গুণগান গেয়েই বা ছবি হবে না কেন? দ্বিতীয়ত, শিক্ষাব্যবস্থায় হাতের কাজের চাইতে মাথার কাজকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া বন্ধ করতে হবে। বহু সহপাঠীর চাইতে নিজেকে ভাল মনে করার ইচ্ছেটা আমার অনেকটাই কমে যেত, যদি জানতাম যে তারাও কাঠের কাজ বা সেলাইয়ের ফোঁড় তোলায় আমার ডাহা অপদার্থতা দেখছে। অবশ্যই যদি না শিক্ষকরা ‘ও কাজগুলো সময় নষ্ট’ বলে পুরো ব্যাপারটা কাঁচিয়ে দেন। সেটাই তাঁরা করেছিলেন, যখন আমাদের হায়ার সেকেন্ডারি পাঠ্যক্রমে ‘ওয়ার্ক এডুকেশন’ ঢোকানো হল।
তৃতীয়ত, আমাদের রাস্তাঘাট, অফিস-কাছারি আরও নিরাপদ করতে হবে, বাড়ির কাজ সকলের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে হবে, যাতে মেয়েদের প্রতিভা ও কর্মক্ষমতা কাজে লাগাতে পারে আমাদের দেশ। বাংলাদেশের পোশাকের কারখানাগুলোয় শ্রমিকের কাজ করছে প্রধানত মেয়েরা। এদেশেই বা তা হবে না কেন?
শেষ, এবং সব চাইতে কঠিন পদক্ষেপ হল, আমাদের সরকারি চাকুরেদের কম কাজ-বেশি মাইনে দেওয়া বন্ধ করা। কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাঙ্কের রিঙ্কু মুরগাই এবং ল্যান্ট প্রিচেট হিসেব কষে দেখিয়েছিলেন যে, সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা (চুক্তিতে নিযুক্ত নয়, পুরো সময়ের শিক্ষক) গড়ে প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষকদের চাইতে সাতগুণ বেশি মাইনে পান। এটা ঠিকই যে সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা গড়ে বেশি। কিন্তু তার জন্য প্রাপ্য বাড়তি সুবিধে যদি হিসেব কষে বাদ দেওয়া হয়, তা হলেও বেতনে তফাতটা দাঁড়ায় প্রায় আড়াইগুণ। তার সঙ্গে পেনশন ও অন্যান্য সুবিধে তো আছেই। অথচ বাড়তি অভিজ্ঞতা থাকলেও তাঁরা যে আরও ভাল পড়াচ্ছেন, তেমন কোনও প্রমাণ মেলেনি। বরং উলটো প্রমাণই মিলেছে। তাঁদের চাকরি যে সুরক্ষিত, ফলে ভাল পড়ানোর, এমনকী নিয়মিত ক্লাসে আসার কোনও তাগিদ তাঁদের নেই, তা সম্ভবত সেগুলোর প্রতিফলন। (তাঁদের বাড়তি অভিজ্ঞতাকেও এর নিরিখে দেখতে হবে। তাঁদের মতো কর্মীরা প্রাইভেট স্কুল থেকে ছাঁটাই হয়ে যাবেন, অভিজ্ঞতা বাড়ানোর সুযোগই পাবেন না।) সরকারি চাকরির সব সুবিধেগুলো যদি কেউ মিলিয়ে দেখে— বেসরকারি চাকরির চাইতে অনেক বেশি মাইনে, অন্যান্য বাড়তি সুবিধে, চাকরির সুরক্ষা, কাজ করার বাধ্যবাধকতা সামান্য— তা হলে স্পষ্ট হয় আমাদের তরুণ-তরুণীরা গা ঘামিয়ে কাজ করার চাইতে কেন বছরের পর বছর সরকারি চাকরি পাওয়ার ফাটকা খেলেন। আরও একটা কোর্স করলে, আরও একটা পরীক্ষা দিলে, যদি এমন চমৎকার চাকরি পাওয়ার মাত্র এক শতাংশ সুযোগও থাকে, তা ছাড়া যায় নাকি? যে সব কাজ তাঁরা করতে চান না, সেগুলো তো আর পালাচ্ছে না। সরকারি চাকরি পাওয়ার আশা ছেড়ে একদিন ভাঙা মনে তাঁরা সেই সব কাজে নাম লেখাবেন। ততদিন দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির স্বপ্ন না হয় অপেক্ষা করে থাক।