যেখানে শ্রোতারা তথ্য, যুক্তি শোনার চাইতে বক্তার মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করে বেশি, সেখানে বক্তার উপরেও চাপ তৈরি হয় শ্রোতাদের সঙ্গে ভাবনাচিন্তা আদানপ্রদানের চাইতে গোড়াতেই কোনও একটা অবস্থান নিয়ে নেওয়ার। তখন সব বক্তব্যই রাজনৈতিক বক্তব্য হয়ে যেতে চায়, কারণ শেষ অবধি শুধু সেটাই টিকবে। সেই জন্যই ওই তরুণীর মনে হয়েছে তাঁর জানা দরকার, ‘গোপন উদ্দেশ্যটা কী?’
বরাবরই কি এমনই ছিল? হয়তো না। সত্তরের দশকে ভারতে দারিদ্র এবং কৃষির উপর সব চাইতে ভাল কাজ যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনজন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। টি এন শ্রীনিবাসন সগর্বে নব্য উদারনীতি সমর্থন করতেন, অশোক রুদ্র ছিলেন অ-মার্কসবাদী, আর প্রণব বর্ধন বামপন্থী। কখনও তিনজনে, কখনও কোনও দু’জন একসঙ্গে কাজ করেছেন। কেউ কি তাঁদের প্রশ্ন করেছিল, কোন গোপন উদ্দেশ্যে তিনজন কাজ করছেন? প্রশ্ন করলে তাঁরা কী-ই বা বলতে পারতেন? কেবল বলতেন, ‘কী ঘটছে, আমরা আসলে সেটুকু জানতে চাই।’
কেন আজ আর লোকে তথ্য জানতে আগ্রহী নয়? হয়তো তার একটা কারণ, ভারতে সরকারি তথ্যের মান ক্রমশ পড়ছে। একটা সহজ কিন্তু উদ্বেগজনক উদাহরণ দেওয়া যাক— জাতীয় আয়। কেউ যদি জাতীয় নমুনা সমীক্ষার পরিসংখ্যান থেকে তা গণনা করে (যা করা যেতে পারে, যেহেতু এটা প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা), তা হলে যে-সংখ্যা পাওয়া যাবে, তা সেন্ট্রাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অর্গানাইজেশনের দেওয়া সংখ্যার অর্ধেক। দ্বিতীয়টিই আমরা বিশ্বকে জানাই। যা আরও উদ্বেগের তা হল, জাতীয় আয় নিয়ে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া হিসেবের মধ্যে ফারাক গত ২০ বছর ধরে ক্রমে বেড়েই চলেছে। তা হলে কোন হিসেবটার উপর ভরসা করব?
তবে সমস্যার মূল আরও গভীরে। শিশুদের পড়তে পারা-অঙ্ক কষতে পারার মূল্যায়নের জন্য একটি রিপোর্ট (অ্যানুয়াল সার্ভে অব এডুকেশন রিপোর্ট বা ‘অসর’) তৈরির কাজের তত্ত্বাবধান করেন রুক্মিণী বন্দ্যোপাধ্যায়। শিশুরা কী শিখছে, তা বুঝতে ভারতের ৬০০ জেলার প্রতিটিতে প্রায় হাজার শিশুকে পরীক্ষা করা হয় এই রিপোর্ট বানাতে। সম্প্রতি এক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদের সঙ্গে দেখা হয় রুক্মিণীর। তাঁকে সমীক্ষা থেকে পাওয়া কিছু উদ্বেগজনক ফলাফলের কথা বলছিলেন রুক্মিণী (শেখার মান নিচু থেকে আরও নিচু হচ্ছে) যা শুনে ওই অর্থনীতিবিদ হাত নেড়ে বলেন, আপনাদের ফল কেউ বিশ্বাস করে না। ভদ্রলোক কিন্তু এমন বলছেন না যে, তাঁরাও কয়েক লক্ষ ছেলেমেয়েকে নিয়ে একই ধরনের সমীক্ষা করে ভিন্ন ফল পেয়েছেন। স্রেফ, ‘কেউ বিশ্বাস করে না আপনাদের ফল।’ যদিও ‘অসর’ রিপোর্টের ফল অন্য অনেকে ফের পরীক্ষা করেছে, যদিও ‘প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষাতেও ভারতের ফল ‘অসর’-এর ফলের মতোই খারাপ হয়েছে। যদি সততার সঙ্গে সংগৃহীত পরিসংখ্যান, আর তার স্বচ্ছ বিশ্লেষণে উত্তর খুঁজে না পাওয়া যায়, তা হলে আপনার-আমার গোপন অভিসন্ধি ছাড়া থাকে কী?
আমার অন্তত মনে হয়েছে, এবার জয়পুর সাহিত্য উৎসবের সব চাইতে ভাল আলোচনাটি হল সাহিত্য সাংবাদিকতা নিয়ে। বিশ্বের পাঁচজন সেরা সাংবাদিক সেখানে তথ্যকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়ার কথা বললেন। আশা করি অন্তত তরুণ-তরুণীরা সেটা শুনেছেন।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১২
শ্রমের জয়
শ্রম এব জয়তে। স্বর্গে হয়তো এমনটা হতে পারে, এই ভারতে ‘শ্রম’ জিনিসটার স্থান সবার শেষে। আমার যে-বন্ধুরা কর্মী নিয়োগ করেন, তাঁরা নালিশ করেন যে দৌড়োদৌড়ি করে কাজ করার লোক পাওয়াই মুশকিল। সকলেই খোঁজে চেয়ার-টেবিলে বসে করার কাজ। তার মানে কেবল বসে কাজ করতে হবে, এমন নয়। কল সেন্টারে কাজ করতে হয় চেয়ারে বসে, কিন্তু সারাদিনে অনেক লোকের সঙ্গে কথা বলতে হয়, তাদের চেঁচামেচি শুনতে হয়। এদেশে পছন্দের কাজ মানে, শান্তিতে টেবিলে বসে ফাইল ঠেলার কাজ। তার জন্য রোজগারে ঘাটতিও মানতে রাজি অনেকে। বেকারত্বের জ্বালায়, বা কিছু টাকার লোভে যাঁরা দৈহিক পরিশ্রমের কাজ শুরু করেন, তাঁদের অধিকাংশ মাস তিনেকের মধ্যে তা ছেড়ে দেন। ফলে নিয়োগযোগ্য লোকের সংখ্যার নিরিখে আমরা চিনকেও ছাড়িয়ে বিশ্বের এক নম্বরে যেতে চলেছি বটে, কিন্তু আমাদের দেশের নিয়োগকর্তারা হন্যে হয়ে এমন লোক খুঁজে চলেছেন যাঁরা কঠোর পরিশ্রমের, বিরক্তিকর বা একঘেয়ে কাজও করতে রাজি আছেন। অথচ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এমন কাজই বেশি।
কেবল কম টাকার কাজকেই বা ধরা কেন? গোটা ব্যবস্থাটাই ঠেলে দিতে চায় শারীরিক পরিশ্রমের উলটো দিকে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সেরা ছাত্ররাও কারখানায় কাজ করার চাইতে ফিনান্স মার্কেটে কাজ করেন (ফিনান্স সংক্রান্ত কোম্পানিগুলো মাইনে যে আপত্তিকর রকম ভাল দেয়, সেটাও সমস্যার একটা অংশ)। কথা ছিল, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট বা আইটিআইগুলো দেশকে এমন ছেলেমেয়ে দেবে যাদের চিন্তার ক্ষমতা আর হাতেকলমে কাজের দক্ষতা, দুটোই থাকবে। দেখা যাচ্ছে, আইটিআই থেকে যত ছেলেমেয়ে পাশ করে বেরোয়, তার পাঁচগুণ বেরোয় কলেজ গ্র্যাজুয়েট হয়ে। অথচ কলেজে ভর্তি হওয়ার চাইতে আইটিআইতে পড়াশোনার শর্ত অনেক সহজ, তাই অনেক বেশি ছেলেমেয়ে আইটিআইতে আবেদন করতে পারত। ‘আর্টস’ নিয়ে পড়ে যত ছেলেমেয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়, তা আইটিআই-পাশ পড়ুয়াদের দ্বিগুণ। সেটা কি আমাদের ছেলেমেয়েদের ইতিহাস বা সাহিত্যের প্রতি বেশি অনুরাগের জন্য? নাকি ‘হাত নোংরা’-করা কাজ এড়ানোর জন্য?