অন্য যে-কোনও নাগরিকের মতো, নাগরিক সংগঠনগুলির নেতা-সদস্যদেরও সে-পথে নেতাদের অনুগামী হতে হবে। নেতা ডিঙিয়ে নেতৃত্ব দেবার কাজ তাদের নয়। নেতাদের উপর ছড়ি ঘোরানোর কাজও নয়। নাগরিক সংগঠন যা পারে, তা হল পক্ষপাতহীনভাবে পরখ করে দেখা যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে-পথে নিয়ে যাচ্ছে মানুষ সে-পথে যথার্থই তার প্রাপ্য পাচ্ছে কি না। নেতার মূল্যায়নের সঙ্গে নাগরিকের অভিজ্ঞতার কোথায় তফাত হয়ে যাচ্ছে, সেটা দেখিয়ে দেওয়া তার কাজ। এ কাজটা করেছে বেঙ্গালুরুর ‘সিটিজেন্স রিপোর্ট কার্ড’ যা জল, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক প্রভৃতি প্রধান নাগরিক পরিষেবাগুলি নিয়ে সে-শহরের মানুষের কতটা সন্তুষ্টি, কতটা ক্ষোভ, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে।
নাগরিকদের সমস্যা কোথায় তা জানার পর অনেক সরকারি দফতর, সংস্থা তাদের পরিষেবাকে নতুন করে সাজিয়েছে। নীতি তৈরিতে পরামর্শ দিতে পারে নাগরিক সংগঠন। কিন্তু নীতি নির্ধারণ করা, কিংবা যেন-তেন-প্রকারেণ একটি নীতি পাশ করিয়ে ফেলার জন্য নেতাদের চাপ দেওয়া তাদের কাজ নয়।
গণতন্ত্র যেখানে কাজ করবে, সেখানে মানুষ নিজের জোরে, নিজের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতার জোরে তার প্রাপ্য পাবে। সে প্রাপ্য তার ‘অধিকার’ বলে আইন-আদালত স্বীকার করল কি না, তার পরোয়া করতে হবে না। মাসে চার দিন মিছিল-অবরোধ করতে হবে না। সরকারি দফতরের দৈনন্দিন ফাইলের পাতাগুলোতে তা-ই লেখা হবে, যা গরিব মানুষ চায়। সেই সব লেখাই ক্রমশ তৈরি করবে পরিবর্তনের ছবি। যে-কোনও নাগরিক আন্দোলন কিংবা রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতার কল্পনার ছবির চাইতে অনেক বৃহৎ, অনেক আশ্চর্য সেই পরিবর্তন।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ ও ১৫ অগস্ট, ২০১২
তথ্যের সম্মান
২০১২ সালের জয়পুর সাহিত্য উৎসবে সাহিত্যিক সলমন রুশদি আসবেন, তা ঘোষিত হতে দেওবন্দ মাদ্রাসার আব্দুল কাসিম নোমানি ভারতে রুশদির আসার বিরোধিতা করেন। উৎসব কর্তৃপক্ষ শেষ দিনে ভিডিও-সংযোগের মাধ্যমে রুশদির বক্তব্য প্রচারের ব্যবস্থা করেন। নোমানির সমর্থকদের বাধায় তা-ও বন্ধ করে দিতে হয়।
এ বছর জয়পুরের সাহিত্য উৎসব চমৎকার জমে গিয়েছিল। খচখচ করেছে কেবল সেন্সরশিপের কাঁটা। সলমন রুশদি আমন্ত্রিত হলেন, তারপর অনাহুত হলেন। তাঁর হয়ে যাঁরা কথা বললেন, তাঁদের জেলে ভরার হুমকি দিয়ে চুপ করানো হল। ভিডিয়োতে রুশদির কথা শোনানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষ অবধি তা রাখা হল না। গোটা ব্যাপারটায় রাজস্থান সরকার যে একবারও দুঃখপ্রকাশ করল না, সেটাই যেন আরও বিশ্রী করে তুলল বিষয়টিকে। সরকারের উদ্বেগ বোঝা কঠিন নয়: কিছু মাথা-গরম মুসলিমকে খেপিয়ে তুললে নানা ক্ষতির সম্ভাবনা-যদি কিছু নিরপরাধ মানুষ আহত হয়, সেই চিন্তা তো থাকেই। কিন্তু আমরা একবারও ‘দুঃখিত’ কথাটা শুনলাম না কেন? রুশদির মতো একজন মস্ত লেখকের কথা শোনার আমাদের সাংবিধানিক অধিকার (এবং রুশদির কথা বলার অধিকার) সরকার যদি রক্ষা করতে না পারে, তা হলে সেই অক্ষমতা স্বীকার করার কি প্রয়োজন ছিল না? অধিকার রক্ষা করার প্রশ্নে সরকার যদি এমন গা ছাড়া ভাব দেখায়, সেটা কি অধিকারের প্রতি অসম্মান নয়?
আমি রুশদি নই। আমাকে চুপ করানোর চেষ্টা করে কেবল আমার ছাত্ররা, যে সব দিনে ক্লাসে আমার লেকচার একটু বেশি রকম দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু আর এক ধরনের সেন্সরশিপ কাজ করে, যখন মানুষ কথা শোনে কিন্তু কানে তোলে না: উৎসবে আমাদের আলোচনার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে এক তরুণী খানিকটা উত্তেজিতভাবে হাত তুললেন। আমার বক্তব্যে আমি খানিকটা বিশদে বলেছিলাম, কীভাবে উত্তরপ্রদেশের গ্রাম শিক্ষা কমিটিগুলো বেশির ভাগ কাগজে-কলমেই রয়ে গিয়েছে। তা শুনে বিচলিত ওই তরুণী বলেন, তিনি হরিয়ানায় বেশ কিছু গ্রাম শিক্ষা কমিটির বৈঠকে গিয়ে দেখেছেন সেগুলো রীতিমতো প্রাণবন্ত, অনেক মহিলা এসে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিয়ে নানা অভিযোগ জানিয়েছেন। তারপরেই ওই তরুণী প্রশ্ন করলেন, আমার লুকোনো উদ্দেশ্যটা কী? আমি কি সব সরকারি পরিষেবা বাতিল করতে চাই, যাতে সব কিছু বেসরকারি হয়ে যায়?
আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম, ওই একটা উদাহরণ থেকে খুব বেশি ধরে নেওয়া চলে না। উত্তরপ্রদেশের ওই গল্পটা বলে আমি কেবল এটুকুই বোঝাতে চেয়েছি যে, সদিচ্ছা থাকলেই ভাল একটা প্রকল্প খাড়া করা যায় না। তবে এ দিনের ব্যাপারটা আমাকে একটু ধাক্কা দিয়েছিল, মানতেই হবে। উৎসবের নানা আকর্ষণে হয়তো তরুণীকে ভুলেই যেতাম, যদি না সেদিন সন্ধ্যায় দ্বিতীয় আর একটা কথাবার্তায় জড়াতাম। আমি যখন কোনও মতে কাবাবের প্লেট ব্যালান্স করার চেষ্টা করছি, তখন সদ্য-আলাপী এক ভদ্রলোক তাঁর বন্ধুদের বোঝাচ্ছিলেন, আমি আলোচনায় কী বলেছি। তিনি বললেন, আমি নাকি বলেছি দারিদ্র দূর করার উপায় আঁতেপ্রেনিয়রশিপ। আমার এই ‘বক্তব্য’ তিনি সমর্থন করেন, তা-ও জানালেন ভদ্রলোক। ঘটনা হল, আমি আঁতেপ্রেনিয়র বা উদ্যোগপতিদের কথা একবারও বলিনি, কেবল ছোট চাষিদের সমস্যার কথা উল্লেখ করেছি। গরিবদের ‘আঁতেপ্রেনিয়র’ করে তোলা নিয়ে যে আগ্রহ-উদ্দীপনা আজকাল দেখা যাচ্ছে, আমার নানা লেখায় আমি বরং তাতে জল ঢেলেছি। কিন্তু যেহেতু আমি সরকারি প্রকল্পের সমালোচনা করেছি, তাই ধরেই নেওয়া হল আমি গরিবদের স্ব-উদ্যোগ সমর্থন করি। ওই তরুণীর মতো এই ভদ্রলোকও আমার কথার মধ্যে কোনও অকথিত বিষয় খুঁজছিলেন, যা সব কিছু ব্যাখ্যা করে দিতে পারে। যখন মনে হয়েছে তা পাওয়া গিয়েছে (‘বেসরকারিকরণ’, কিংবা ‘আঁতেপ্রেনিয়রশিপ’) তখন তাঁরা সেখানেই থেমে গিয়েছেন।