যেখানে সত্যিই গরিবের উন্নয়নকে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মঞ্চে আনা হয়েছে, সেখানে রাজনীতি গরিবের সক্ষমতা তৈরি করে দিয়েছে। যেমন দলিত-আদিবাসী স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের সাইকেল বিতরণ করে নীতীশ কুমার মেয়েদের শিক্ষাকে রাজনীতির বিষয় করে তুললেন। এখন প্রায় প্রতিটি রাজ্যে দরিদ্র মেয়েদের সাইকেল দেওয়া হচ্ছে, মেয়েদের স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার জন্য যার গুরুত্ব অপরিসীম। গরিবের লাভে নেতার লাভ হওয়ার একটা প্রক্রিয়া তৈরি হল, তাই প্রতিযোগিতায় কাজ হচ্ছে গরিবের।
গরিব তার প্রাপ্য পাবে কি না, তা বুঝতে হলে দেখতে হবে, ভোটের লড়াইকে গরিবের প্রাপ্য পৌঁছে দেওয়ার লড়াইয়ে টেনে আনা যাবে কি না। তামিলনাড়ুতে যে দারিদ্র কমে এসেছে, তার কারণ সেখানে ভোটের লড়াইকে অনেকটাই আনা গিয়েছে সেই ময়দানে। যে অঙ্গনওয়াড়িতে শিশুদের ডিম দেওয়া বন্ধ করবে, যে রেশন ব্যবস্থা সংকুচিত করবে কেবল বি পি এল-দের মধ্যে, সে-ই যে ভোটে হারবে তা প্রায় নিশ্চিত। তামিলনাড়ুতে তাই দ্রুত দারিদ্র কমছে। সে-রাজ্যের নেতারা দুর্নীতিতে কিছু কম যান না, কিন্তু গরিবের উন্নয়ন তাতে আটকায়নি।
এখানে বলা দরকার, মত প্রকাশের অধিকারও গণতন্ত্রে মূল্যবান। নির্ভয়ে রাষ্ট্রের সমালোচনা করা গণতন্ত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি বারাসতে এক স্কুল ছাত্রী দুষ্কৃতীদের হাতে হয়রান হলে এক বিধায়ক তার পোশাক নিয়ে মন্তব্য করলেন। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে আর এক নেতা ধর্ষিতা মেয়েটির চরিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। দু’বারই এমন মন্তব্যের প্রতিবাদ করে নানা সংগঠন মিছিল, সভা করল। এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজন, কারণ তা শাসকদের কাছে মানুষের ক্ষোভ পৌঁছে দেয়। কিন্তু মিছিল করে নির্যাতিত মেয়েদের ন্যায় বিচার পাওয়ার কাজটা সহজ করতে আমরা পারব না। ধর্ষণের বিচার করতে আদালতে বহু মাস, বছর কেটে যাবে। এতে বিচারব্যবস্থার ঘাটতি আছে বিলক্ষণ, এবং সেই ঘাটতিগুলো নিয়ে সরব হওয়াও গণতন্ত্রের অংশ। কিন্তু আদালতের পাশ কাটানো চলে না, বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা চলে না। তার জায়গায় ‘জন-আদালত’ তৈরি করার চেষ্টা আরও ভয়ানক।
কোনও ব্যক্তির অপ্রাপ্তির প্রতিকার করা বিচারব্যবস্থার কাজ। যাকে অন্যায়ভাবে বন্দি করা হয়েছে, যার উপর নির্যাতনের অভিযোগ পুলিশ নেয়নি, তার ক্ষেত্রে সেটা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি সেই সব ক্ষেত্রে যেখানে গরিব গ্রাহককে তার প্রাপ্য চাল-কেরোসিন না দিয়ে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে রেশন দোকান, গরিব মেয়েটির স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ঋণ দেয়নি ব্যাঙ্ক, গরিব শিশুটি স্কুলে লেখাপড়া শিখতে পারেনি শিক্ষকের অনুপস্থিতি কিংবা অমনোযোগিতার জন্য। ব্যক্তির কাছে তার প্রাপ্য পৌঁছোনোর ইচ্ছাটা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে জন্মানো ইচ্ছা। কিন্তু তার প্রক্রিয়াতে গণ-আন্দোলনের ভূমিকা যে সীমিত, তা আগেই লেখা হয়েছে।
এ কথাটা অন্যভাবেও বোঝার চেষ্টা করা যায়। প্রশ্ন করা যাক, যেখানে কোনও জনগোষ্ঠী তার প্রাপ্য পেয়েছে, সেখানে কি গণতান্ত্রিক আন্দোলনই তা পাইয়ে দিয়েছে? ধরা যাক দলিত শিশুদের শিক্ষার বিষয়টিই। দলিত ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়াই এখন নিয়ম হয়ে উঠেছে, তাদের পড়াশোনা না-শেখা এখন সমাজের চোখে একটা সমস্যা। ভারতে এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে কারণ স্কুলের সংখ্যা প্রচুর বেড়েছে, দলিত শিশুদের বাড়ির কাছেই তৈরি হয়েছে স্কুল। কিন্তু শিক্ষার জন্য দলিতদের নানা আন্দোলনমূলক কর্মসূচির জন্যই যে তাঁরা অনেক স্কুল পেয়েছেন, কিংবা দলিত-প্রধান রাজনৈতিক দলগুলিই যে দলিতদের জন্য প্রচুর স্কুল তৈরি করেছে, এমন কিন্তু নয়। যে-কোনও জনপদের এক কিলোমিটারের মধ্যে একটি প্রাথমিক স্কুল থাকতে হবে, এই সরকারি নীতি কাজে পরিণত হওয়ায় সব চাইতে লাভবান হয়েছেন দলিতরা। তাঁদের জনপদগুলিতেই বরাবর সব চাইতে কম স্কুল ছিল, তাই এই নীতি মেনে সব চাইতে বেশি স্কুল পেয়েছেন তাঁরা। এই সরকারি কার্যসূচি নেওয়া হয় ইন্দিরা গাঁধীর আমলে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর যাঁর আস্থা খুব বেশি ছিল না। নিতান্ত আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে প্রাপ্য পাইয়ে দেওয়ার কাজে সফল হতে পারে। এটা অবশ্যই দাবি করা যায় যে ইন্দিরা গাঁধীর দারিদ্র বিষয়ক কর্মসূচি নেওয়ার পিছনে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপ ছিল। কিন্তু জনতার চাহিদার চাপ অগণতান্ত্রিক দেশেও রাষ্ট্রপ্রধানকে জনমুখী কার্যসূচি নিতে বাধ্য করতে পারে। ইন্দোনেশিয়াতে সুহার্তোর সময়ে শিক্ষার প্রসার হয়েছিল সর্বাধিক। মোট কথা, গরিবের স্বার্থে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলিকে অতিক্রম করা চলে, দুর্বল করা চলে, এ যুক্তি আমরা মানতে পারছি না।
গরিবের স্বার্থরক্ষায় ভোটের প্রতিযোগিতাকে গরিবের উন্নয়নের ক্ষেত্রে আনতে হবে। সে-কাজটা অনেকটাই পারে মিডিয়া। মিডিয়াতে রাজনৈতিক নেতাদের কাজের বিষয়ে তথ্য যত বেশি প্রকাশিত হবে, তত বেশি সেই তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন সাধারণ নাগরিক। দিল্লি এবং বিহারে দুটি পরীক্ষানিরীক্ষায় এমনই পাওয়া গিয়েছে। দিল্লির বস্তিবাসী যখন মিডিয়া থেকে জানতে পারছেন কোন নেতা বস্তির জন্য কত টাকা খরচ করেছেন, তখন তাঁরা যে বেশি খরচ করেছে তাকে বেশি ভোট দিচ্ছেন। আবার রেশন দোকান পরিদর্শন কমিটির মিটিং-এ যে নেতা বেশি উপস্থিত থাকছেন, তিনি ভোট পাচ্ছেন বেশি। আরও দেখা যাচ্ছে যে, যিনি ক্ষমতাসীন নেতা তিনি যদি কোটিপতি হন, আর বিরোধী যদি তা না হয়, তা হলে ক্ষমতাসীনের ভোট কমে যাচ্ছে। এই গবেষণাগুলি এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, জনসম্পদ কে কেমন খরচ করছেন, বিলিবণ্টন করছেন, সে-বিষয়ে তথ্য ভোটদাতাদের হাতে এলে তাঁদের ভোটের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয়। এটা যত বেশি ঘটবে, তত বেশি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আসবে উন্নয়নের প্রতিযোগিতার মঞ্চে। ‘সব নেতাই এক’ এমন একটা আবছা ধারণা কেটে গিয়ে কে কোন কাজে কত খরচ করছে, সে-বিষয়ে তথ্য আসবে হাতে। তখন উন্নয়নের প্রশ্নে ভোট দিতে পারবেন গরিব মানুষ। দলিত, মহিলা, গরিবদের কাছে তাদের প্রাপ্য পৌঁছনোর এটাই গণতন্ত্রের পথ।