গণতন্ত্র যা পারে, তা হল মানুষের দাবি নিয়ে সরব হতে। সরকারি হাসপাতালে কম দামে ওষুধ চাই, রেশনে এ পি এল গ্রাহকদেরও গম দিতে হবে, অমুক জনগোষ্ঠীকে ‘জনজাতি’ বলে গণনা করতে হবে, রাতবিরেতে গ্রামে তল্লাশি চলবে না, এই চাহিদাগুলিকে গণতন্ত্র ব্যক্ত করে। অনেকের চাহিদাকে একটি নির্দিষ্ট দাবিতে পরিণত করা, এবং তা পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করা এগুলো গণতন্ত্রের মৌলিক কাজ। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি মেনে রাষ্ট্র যে গরিবের জন্য কিছু প্রাপ্য নির্দিষ্ট করেছে, ভারতে গণতন্ত্র কাজ করছে বলেই হয়তো তা সম্ভব হয়েছে।
সমস্যা হল, একজন গরিব মানুষ যখন তাঁর প্রাপ্য দাবি করেন, সে রেশন দোকানেই হোক বা সরকারি হাসপাতালেই হোক, তখন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি খুব সহজেই তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে পারে। হবে না, আজ নেই, কখনও পাওয়া যায় না, অমুকের সার্টিফিকেট নিয়ে আসুন এমন নানা অজুহাতের জাল বোনা হয়। এর প্রতিকার কী? গণতন্ত্রে এটার প্রতিকার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রাথমিকভাবে আদালতকে। তা এই আশঙ্কা থেকে যে, একজনের প্রতি বিচার করতে গিয়ে অন্য একজনের প্রতি অন্যায় না হয়ে যায়। ‘জনস্বার্থ’ প্রতিষ্ঠা করার যে গণ-উত্তেজনা, তা থেকে দূরে থেকে ঠান্ডা মাথায় বিচার করবে আদালত। গণতন্ত্রের নামে যেমন আদালতের উপর চাপ সৃষ্টি করা চলে না, তেমনই এমন কোনও বিচারব্যবস্থার সুপারিশও করা চলে না, যেখানে বিচারকই তদন্ত করবেন।
সেই সঙ্গে, ‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র’ দিয়ে সরকারি কর্মীর উপর চাপ সৃষ্টি করা, তাকে শাস্তি দেওয়াটাকেও সমর্থন করা চলে না। অণ্ণা হজারে সংগঠিত ‘গ্রাম সভা’ কিংবা অরুণা রায় সংগঠিত ‘জন সুনওয়াই’ যে পঞ্চায়েতের দুর্নীতি, অকর্মণ্যতা প্রকাশ করেছে, সেটা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু অভিযুক্ত প্রধানকে বা সরকারি কর্মীকে বরখাস্ত করে দেওয়াটা ভোটের মাধ্যমে বা আদালতের মাধ্যমেই সম্ভব। স্বনির্বাচিত জনগণের নেতারা জনগণের নামে কারও হাতে মাথা কাটবেন, এটা গণতন্ত্রের পদ্ধতি নয়। এটা নীতিগত সমস্যা। তা ছাড়া বাস্তব সমস্যাও রয়েছে। ‘সংগঠিত প্রতিবাদ’ তৈরি করা কত কঠিন, তা নাগরিক সংগঠন মাত্রই জানেন। একত্র হবার সুযোগ পেলেই তা কাজে লাগিয়ে মানুষ প্রাপ্য আদায় করবেন, এই ধারণা যদি ঠিক হত তা হলে গ্রাম সভা, স্কুল শিক্ষা কমিটি, রেশন দোকান পরিদর্শন কমিটি, এমন অজস্র তৃণমূল স্তরের জনমঞ্চ এতদিনে গ্রামীণ প্রশাসনের মুখটাই বদলে দিত। এতদিনে বোঝা গিয়েছে যে, যোগদান নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াও জটিল, শ্রমসাধ্য, ব্যয়সাধ্য। সে অমনি হবার নয়। অরুণা রায়, অণ্ণা হজারে যা করেছেন, আটপৌরে জনজীবনে গণতন্ত্র তা করে না। তাই তাঁরা ‘দৃষ্টান্ত’ হলেও ‘মডেল’ নন।
তা হলে শূন্য রেশন ব্যাগ-হাতে গরিব লোকেদের কী হবে? গণতন্ত্র তাঁদের প্রাপ্য লাভ নিশ্চিত করার জন্য কী করতে পারে?
ভারতে আমরা প্রতিনিধিত্ব-মূলক গণতন্ত্র মেনে নিয়েছি। তার মূল কথা, নির্বাচিত প্রতিনিধি দেখবেন, সরকারি কর্মী যাতে মানুষের প্রয়োজনে কাজ করেন, তাঁদের প্রাপ্য তাঁদের কাছে পৌঁছে দেন। আমলাদের কাজের হেরফের গরিবের লাভের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে অনেকটাই। তাঁদের তৎপর, দায়বদ্ধ করা যায় কী করে, সেটা বরাবরই একটা চ্যালেঞ্জ। সরকারি কর্মী যে নিয়মিত নিজেদের কাজ করছে, আলস্য বা দুর্নীতি করে নাগরিককে ঠকাচ্ছে না, তা নিশ্চিত করাই জনপ্রতিনিধিদের কাজ। খাদ্য, কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো প্রভৃতি যা কিছু ‘সার্বিক অধিকার’ বলে রাষ্ট্র স্বীকার করেছে, সেই সব প্রাপ্য বস্তু বা পরিষেবা পাবার এটাই উপায়। আজ ‘শিক্ষার অধিকার’ কাল ‘খাদ্যের অধিকার’ এমন নতুন নতুন অধিকার তৈরি করে আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করে কর্মীদের কাজ করানো গণতান্ত্রিক উপায় নয়। তার প্রধান কারণ (যা আগেই আলোচিত) গণতন্ত্রের মূল ধারণা অভিযুক্তের সুবিচার নিশ্চিত করা। সকলের প্রাপ্য দ্রুত পাইয়ে দেওয়ার স্বার্থে সরকারি কর্মীদের উপর শাস্তির খাঁড়া ঝুলিয়ে রাখা, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ না দেওয়া, গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এটার পিছনে আছে গণতন্ত্রের মৌলিক কথা। ব্যক্তিস্বার্থ এবং সার্বিক স্বার্থের একটা ভারসাম্য রাখতে হয় গণতন্ত্রে। আমাদের দেশে তা নিশ্চিত করা হয়েছে, ব্যক্তিস্বার্থকে বিচারব্যবস্থার, এবং সার্বিক স্বার্থকে আইন বিভাগ-শাসন বিভাগের বিষয় করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে স্বাতন্ত্র্য এবং ভারসাম্য রাখার মাধ্যমে ব্যক্তিস্বার্থ এবং সার্বিক স্বার্থে ভারসাম্য রাখা হবে, এই ধারণাই কাজ করছে ভারতে।
গণতন্ত্রের ধারণা মেনে গরিবের কাছে তার প্রাপ্য পৌঁছতে যা দরকার, তা হল রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা। সমর্থন আদায় করার জন্য যেখানে বিজলি-সড়ক-পানি, কিংবা শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো জনসম্পদ সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলবে, সেখানেই গরিবরা লাভবান হবে সবচেয়ে বেশি। গণতন্ত্রে আমলাদের উপর চাপটা এভাবেই আসার কথা। কিন্তু তা হয় না, কারণ ভোটের লড়াইটা ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধে পাইয়ে দিয়ে, কিংবা ভয় দেখিয়ে সমর্থন আদায় করার প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে গরিবের ক্ষতি বেশি, কারণ অতি সামান্য কিছু দিয়ে তার ভোট আদায় করা সম্ভব।