- বইয়ের নামঃ বিকল্প বিপ্লব : যে ভাবে দারিদ্র কমানো সম্ভব
- লেখকের নামঃ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
বিকল্প বিপ্লব : যে ভাবে দারিদ্র কমানো সম্ভব
০. ভূমিকা / মুখবন্ধ
এই সংকলনের প্রবন্ধগুলি ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে লেখা হয় এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে সাতটি প্রবন্ধ দুই লেখক একসঙ্গে লেখেন, বাকিগুলি তাঁরা এককভাবে লিখেছেন। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে লেখাগুলি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলি বাংলায় অনুবাদ করেছেন স্বাতী ভট্টাচার্য। প্রতিটি প্রবন্ধের শেষে প্রকাশের স্থান-কাল দেওয়া রইল।
সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রবন্ধে অনেক সময়েই কোনও ঘোষণা বা ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ধরা থাকে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আরও নতুন বিষয় সামনে আসে, নতুন কোনও বিশ্লেষণ বেশি গুরুত্ব দাবি করে। কিন্তু তাকে জায়গা দিতে হলে তৎকালীন প্রতিক্রিয়ার স্বাদ-গন্ধ আর থাকে না। তাই প্রবন্ধগুলির মূল রূপটিই সংকলনে রাখা হল। প্রবন্ধের প্রেক্ষিতটুকু ধরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন মতো তখনকার ঘটনা, আর তার পরবর্তী ঘটনাক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণ রইল।
নানা সময়ে, নানা বিষয় নিয়ে লেখা হলেও এই সংকলনের সব প্রবন্ধের মূল প্রশ্ন এক। তা হল, দারিদ্র কমানোর জন্য যে সব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যে টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে, তা বাস্তবিক গরিবের কতটা কাজে লাগছে? যেখানে তেমন কাজে লাগছে না, সেখানে কেন লাগছে না? এর কোনও বাঁধাধরা উত্তর নেই। কী কাজ করে, কী করে না, তার উত্তর খুঁজতে হলে বার বার যেতে হবে গ্রাম-শহরে গরিবের কাছে। নীতি-নির্ধারক, গবেষক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, কেউ এমন সরেজমিনে তদন্তের কাজটা এড়াতে পারেন না। ‘ফ্রি’-তে কিছু দিলে সেটা কাজে লাগবে না, কিংবা গরিবের মতামতকে গুরুত্ব দিলে কাজ ভাল হবে, এমন কোনও বাঁধাধরা ফর্মুলা যে কাজ করে না, তা নানা সমীক্ষা-বিশ্লেষণে বার বার স্পষ্ট হয়েছে। কী কাজ করে, তা একটি বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কষ্টিপাথরে বিচার করে নেওয়া দরকার। যে পদ্ধতির অন্তর্নিহিত দর্শন এই যে, হাতেকলমে পরখ না করে দারিদ্র-নিরসনের প্রকল্পের কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দুরূহ। এই ধারণা থেকে অর্থনীতিতে গবেষণার একটি বিশিষ্ট ধারা ক্রমশ তৈরি হয়েছে। কিন্তু গবেষকদের বাইরেও, দারিদ্র-সম্পর্কিত নানা ধরনের কাজে যে তার চর্চা, অনুশীলন প্রয়োজন, সেই বিশ্বাস থেকে গণমাধ্যমের জন্য লেখা এই প্রবন্ধগুলি বই আকারে প্রকাশের এই উদ্যোগ।
আমরা ধন্যবাদ জানাই সেই সব গবেষকদের, যাঁদের কাজ থেকে নিষ্কাশিত সিদ্ধান্ত এইসব প্রবন্ধে বার বার প্রতিফলিত হয়েছে। সরকারি দফতর, বেসরকারি সংস্থার যে সব সহযোগীরা গবেষণা, সাংবাদিকতার কাজে সাহায্য করেছেন, তাঁদেরও কৃতজ্ঞতা জানাই। সর্বোপরি, গ্রাম-শহরের যে গরিব মানুষেরা নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, অসময়ে এসে-পড়া সাংবাদিক-গবেষকদের নানাভাবে সমাদর করেছেন, তাঁদের কাছে আমরা চিরঋণী।
ভূমিকা
অনাহারে দেহ যখন ভেঙে পড়ে, তখন মাথাও আর কাজ করে না। তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময়ে কলকাতার হাসপাতালে এমন এক উন্মাদকে দেখেছিলেন বাংলার সার্জেন-জেনারেল। দেহ কঙ্কালসার, ক্ষয়া দাঁতের অনেক উপরে গুটিয়ে আছে শুকনো ঠোঁট, গা-ময় ঘা। সামনে রাখা ভাত-তরকারির থালা। কিন্তু সে খাচ্ছে না, একটানা চেঁচিয়ে চলেছে। সাহেব ডাক্তার জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলেন, ভাত চাইছে সে। সামনেই ভাত, তা বোঝার অবস্থা তার নেই।
তেতাল্লিশের মন্বন্তরের ছবি কম নেই। কলকাতার ফুটপাথে মৃতদেহ, মৃত শিশু কোলে মা, লঙরখানার লাইন, ডাস্টবিনে কুকুরে-মানুষ লড়াই। চিত্তপ্রসাদ, জয়নুল আবেদিনের স্কেচে, সোমনাথ হোরের ভাস্কর্যে, দ্য স্টেটসম্যান কাগজের ফটোগ্রাফে সেই নামহীন মুখহীন মানুষগুলো আকালের সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে। আজকের আলো-ঝলমলে কলকাতার পিছনে, ছবির নেগেটিভের মতো, সেই মন্বন্তরের শহর। রাজভবনের পরিধি ঘিরে সেদিন কে বা কারা মৃত আর মৃতপ্রায়দের পরপর শুইয়ে রেখে গিয়েছিল। পথে যেতে যেতে এক মেমসাহেব সেই কিলোমিটার-দীর্ঘ শবমালা দেখেছিলেন। তবু সার্জন-জেনারেলের রিপোর্টে যে লোকটিকে পাওয়া যায়, সে-ই যেন দুর্ভিক্ষের আসল ছবি। সেদিনও খাবার তো ছিল। প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের নির্দেশে বাংলার বাজার থেকে, চাষির ঘর থেকে চাল কিনে নেওয়া হয়েছিল জোর করে। কাজে লাগতে পারে, এই ভেবে মধ্যপ্রাচ্যে প্রয়োজনের চাইতে বেশি চাল মজুত করেছিল ব্রিটেন। খাস কলকাতার সরকারি গুদামে মজুত ছিল চাল, কালোবাজারি হয়েছিল দেদার। চাল পৌঁছয়নি শুধু বাংলার গ্রামে। ত্রিশ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল ১৯৪২-৪৩ সালের মন্বন্তরে, সে চালের অভাবে নয়। চাল না পেয়ে।
দুর্ভিক্ষের পঁচাত্তর বছর হতে চলেছে। ভারত গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়েছে প্রায় সত্তর বছর। দেশের সরকার অনেক টাকা বরাদ্দ করে গরিবের জন্য। গরিবের অন্ন-আবাস-রোজগার, তার মেয়ের বিয়ে থেকে ছেলের ব্যবসা, সব কিছুর জন্য সরকার উপুড়হস্ত। ক্ষুধাকাতর মানুষের সংখ্যাও দ্রুত কমেছে— যাঁরা মনে করেন তাঁরা যথেষ্ট খেতে পান না, এমন মানুষ ১৯৮৩ সালে ছিল ১৭ শতাংশ, ২০০৪ সালে দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশ। কিন্তু ভাতের থালার সামনে ভাতের জন্য আর্তনাদ আজও যেন দারিদ্রের প্রতীক। বিপুল বরাদ্দ সত্ত্বেও আজও এ দেশে, এ রাজ্যে, শিশুরা অপুষ্ট। আফ্রিকার গরিব দেশের তুলনায় ভারতের আর্থিক অবস্থা অনেক ভাল, কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের চাইতে রোগা, বেঁটে, হালকা। ঘানার শিশুপুষ্টির হারে পৌঁছতে ভারতের ২০৩০ সাল হয়ে যাবে, চিনকে ছুঁতে ২০৫৫। আমাদের গরিব ছেলেমেয়েদের একটা বড় অংশ স্কুল শেষ করে না। যারা স্কুলে যায়, তাদেরও অনেকের অক্ষর পরিচয় হয় না। পাকা বাড়ি, ভাল স্বাস্থ্য, নিয়মিত রোজগার, সুলভ ঋণ, যা কিছু গরিবকে স্বস্তি দিতে পারে, তার দারিদ্র কমাতে পারে, তার একটা বড় অংশই গরিব ছুঁতে পারেনি। অথচ থালা-ভরা ভাত-তরকারির মতো, তার জন্য সাজানো ছিল সব কিছুই। এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এক টাকা খরচ করা হলে ১৭ পয়সা পৌঁছয় গরিবের কাছে। দীর্ঘ উপবাসে উন্মত্ত মানুষ নয় ভাত চিনতে ভুল করেছিল। হৃষ্টপুষ্ট নেতা-আমলাদের কোথায় ভুল হচ্ছে? সরকার টাকা ঢালার পরেও গরিব কেন গরিব থেকে যাচ্ছে?