শূন্যতার বুকে কিছু একটা ফুটে উঠছে। পাতলা রেখার একটা গ্রিড। যেন গ্রাফ পেপারের বিশাল কোনো পাতা। বর্ধিত হচ্ছে উপরে আর নিচে। ডানে আর বামে। দৃষ্টি যতদূরে যায় ঠিক ততদূরে। মাথা নাড়ানোর চেষ্টা করে সে মরিয়া হয়ে। চোখের সামনে থেকে সরে না দৃশ্যটা।
গ্রিডের ওপার থেকে সংখ্যা উঠে আসছে। পড়ার কোনো উপায় নেই, এত দ্রুত। কিন্তু সম্ভবত কোনো একটা সার্কিট তাদের রেকর্ড করে নেয়। পোল না হেসে পারে না। (গাল কি নড়েছিল সে হাসির সময়ে?) এসবইতো পরিচিত! এটাতো সেই কম্পিউটার চালিত চোখ পরীক্ষার মতো যেটা তার আমলের অকুলিস্টরা রোগিদের উপর চালাত।
উবে গেল গ্রিডটা। রঙের পরিচ্ছন্ন শিটে ভরে গেল দৃষ্টিসীমা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেগুলো বর্ণালির সবগুলো রঙে ঝলকে উঠতে লাগল। তোমাদের আগেই বলে রাখতে পারতাম,’ বলল পোল নিরবে, আমার কালার ভিশন খুবি স্বচ্ছ। একেবারে যুতসই। পরের পরীক্ষাটা নিশ্চয়ই শ্রবণশক্তির?
আন্দাজটা ঠিক। প্রথমে মৃদু লয়ে একটা ঢাকের গুড়গুড় আওয়াজ উঠল। আস্তে আস্তে আরো নিচু হয়ে তারপর উঁচু হতে শুরু করল। সবশেষে শ্ৰবণসীমার শেষপ্রান্তে নেমে গেলে, নেমে গেল বাদুড় আর ডলফিনের রাজ্যে।
সরল, সোজাসাপ্টা পরীক্ষার এখানেই ইতি। একটু পরই অনেক ধরনের ঘ্রাণে ভরে গেল মনোজগত। কিছু কিছু খুবি মিষ্টি। বাকিগুলো বীভৎস। এরপর সে পরিণত হল, মনে হয় এমনি, পরিণত হল অদৃশ্য কোনো হাতের পুতুলে।
ধারণা করল সে, নিউরোমাস্কুলার কন্ট্রোল চেখে দেখা হচ্ছে। আশা করছে, এসবের কোনো প্রভাব তার শরীরে পড়বে না। শরীর, হাত, পা নড়বে না। যদি তাই হয় তো বেশ হাস্যকর ব্যাপার। দেখাবে সেন্ট ভিটাসের নাচের টার্মিনাস এন্ডের মতো।
এরপর কী হল সে বুঝতে পারল না। তলিয়ে গেল স্বপ্নহীন ঘুমের জগতে।
নাকি শুধু স্বপ্নে দেখল ঘুমের ব্যাপারটা? জেগে ওঠার আগে কতটা সময় পেরিয়ে গেছে সে সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। মাথায় আর হেলমেটটা নেই। হদিস নেই ব্রেইনম্যান বা তার সেই ল্যাপটপের মতো যন্ত্রটারও।
‘সব চলেছে ঠিকমত।’ বলল মার্টন, কোন সমস্যা যে নেই সেটা বের করতে মাত্র ঘন্টা কয়েক লাগবে। যদি আপনার রিডিং কে. ও. হয়- আই মিন ও. কে. হয়- কালই পেয়ে যাবেন আপনার ব্রেনক্যাপ।
পোল বেচারার আদ্যিকালের ইংরেজি শিখে নেয়ার খাটুনির ব্যাপারটা ঠিক ঠিক টের পেয়ে গেল। তবু, কপাল খারাপ, মার্টনের স্লিপ অব টাং হতেই পারে।
ফাইনাল ফিটিংয়ের সময় চলে এসেছে। পোল যেন কোনো বাচ্চা ছেলে। ফিরে গেল সে ছেলেবেলায়। যেন ক্রিসমাস ট্রির নিচ থেকে কোনো আনকোরা নতুন উপহার তুলে আনবে।
‘আপনাকে আবার সেসব সেটিংআপের সাথে মানিয়ে নিতে হবে না এবার। ব্রেইনম্যান আশ্বস্ত করছে, মুহূর্তেই ডাউনলোড় শুরু হয়ে যাবে। মাত্র মিনিট পাঁচেকের একটা ডেমো দিচ্ছি। আশা করি আপনি উপভোগ করবেন।
শান্ত, নিবিড় হয়ে আসে মিউজিকের লয়, ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাকে। সেই হাজার বছর আগের চির পরিচিত কোনো এক বাজনা। কোনোটা, ধরা যায়শা। চোখের সামনে কুয়াশার ভারি পর্দা। সামনে এগিয়ে যাবার সাথে সাথে সরে গেল সেটা…
তাইতো, সে হাঁটছিল। কল্পনাটা একেবারে বিশ্বাসযোগ্য; মাটিতে পা পড়ছে। তরঙ্গ উঠছে সেখান থেকে। পায়ে মাটির ঈষৎ কোমল অনুভূতি হচ্ছে। কোথায় হারিয়ে গেল বাজনাটা, বোঝা যায় না। চারধারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল বৃক্ষরাজি। ক্যালিফোর্নিয়া রেডউড। কে জানে, এখনো তারা এই পৃথিবীর কোনো না কোনো জায়গায় উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে আছে কিনা হাজার বছরের প্রযুক্তিগত বিবর্তনের পথ পেরিয়ে।
আস্তে আস্তে বেড়ে যায় চলার গতি। সময়ও যেন বয়ে যাচ্ছে দ্রুতলয়ে। আরো গতি বাড়ে। আরো, আরো। গতি বাড়ানোর চেষ্টার যে একটা ধাক্কা আছে সেটা গায় লাগছে না। যেন অন্য কোনো মানুষের গায়ে ভর করেছে প্রেতাত্মা হয়ে। উত্তেজনাটা থিতিয়ে এল একটা ভাবনার সাথে, তার এসব কাজে তো নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই! থামা বা দিক বদলানোর চেষ্টা করে কোনো লাভ হল না।
তাতে কিছু এসে যায় না। সে এ মাদকতায় চুর হয়ে যাচ্ছে। এ ছুটাছুটি ভাল লাগছে তার। সেই ‘ড্রিম মেশিন’ যেটার আশায় বুক বেধে ছিল তার আমলের অনেক বিজ্ঞানী, সেটা এখন হাতের মুঠোয়। পোল ভেবে পায় না কী করে মানুষ সারভাইভ করল, তাকে জানানো হয়েছিল যে মানবজাতির বেশিরভাগই টিকে যেতে পারেনি। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের মস্তিষ্ক জ্বলে গিয়েছিল। হারিয়ে গিয়েছিল তারা অতলে।
অবশ্যই, সেসবের দিন অনেক আগে কেটে গেছে। এখন, এই অসাধারণ যন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে চিনতে হবে তৃতীয় সহস্রাব্দটাকে। কয়েক মিনিটে এমন সব ব্যাপার মাথায় চলে আসবে যেগুলো আগে আয়ত্ত করতে বছরের পর বছর সময় লেগে যেত। অবশ্য, সে মাঝে মাঝে, খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে গেলে, ব্রেনক্যাপকে নিখাদ উপভোগের জন্য ব্যবহার করবে….
বনের শেষপ্রান্ত হাজির, সামনে খরস্রোতা এক চওড়া নদী। কোনো প্রকার অস্বস্তি ছাড়াই নেমে পড়ল সেখানে। চারধারে পানি। পানি গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে আস্তে আস্তে। উঠে যাচ্ছে শরীর ছাড়িয়ে উপরে, আরো উপরে। নেমে যাচ্ছে সে অতলে। সেখানেও স্বাভাবিকভাবেই শ্বাস নেয়া যাচ্ছে দেখে একটু অবাক না হয়ে পারল না। আরো অবাক করা ব্যাপার, ভোলা চোখে মানুষ যেখানে খুব একটা বেশি দেখতে পাবে না এমন এক মাধ্যমে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। এই অবাক করা দুনিয়ায় পাশ কেটে চলে গেল একটা ট্রট মাছ। সেটার গায়ের প্রতিটা অংশ স্পষ্ট দেখা যায়।