তারপর, নিজেকে শুনিয়ে বাকীটা বলল, মনে মনে, দ্রুত দেখা যাবে দাদা কী ভাবছিল… বেশিদূরে নয়, মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে। দেখা হলে গল্পের কোনো অভাব হবে না। আর এক হপ্তাও নেই, যদি সব ঠিকঠাক চলে তো।
৫০. উন্মুক্ত নগরী
কী ভয়ঙ্কর স্থানরে বাবা! ভাবল ক্রিস ফ্লয়েড। চলমান হিমবাহ, তুষারের ঘূর্ণি, ভূমির চকিত দেখা পাওয়া আর… এই তুলনায় স্বর্গ তো এক আস্ত বেহেস্ত। নাতিশীতোষ্ণ চমৎকার আবহাওয়া সেখানে।
জানে, এরচে অনেক খারাপ হাল রাতের প্রান্তে। আর মাত্র কয়েকশো কিলোমিটার দূরেই সত্যিকার দোযখ মুখ ব্যাদান করে তাকিয়ে থাকে সারা রাত। রাত আর ফুরায় না।
অবাক চোখে তারা দেখল, লক্ষ্যে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে পরিবেশ কেমন শান্ত হয়ে এসেছে। হারিয়ে গেছে মেঘের কুয়াশা, আর ঠিক সামনেই ভেসে উঠেছে কালো একটা বিশাল দেয়াল। প্রায় এক কিলোমিটার উঁচু; বিল টির উড়াল পথে সরাসরি দাঁড়িয়ে আছে, বুক চিতিয়ে।
জিনিসটা এত্তো বড় যে নিজেই একটা পরিবেশ আর আবহাওয়া গড়ে নিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্যে। চারপাশে বাতাস গুমরে মরছে শান্ত সুরে, ঠিক পাদদেশে একটা শান্ত, নিরাবেগ পরিবেশ। দেখে সাথে সাথেই বোঝা যায় যে এই কালো মনোলিথটা দূরের সূর্যের মলিন আলোয় নেয়ে গেলেও এটাই বৃহস্পতিকে একেবারে গিলে খেয়েছিল। পায়ের কাছে তূপ তূপ করে রাখা তুষার। দেখে কেন যেন পৃথিবীর মৌচাকের কথা মনে পড়ে যায়। কেন একথা মনে হয় কে জানে!
এক ধাপ এগিয়ে আছে ভ্যান ডার বার্গ, চিন্তার দিক দিয়ে।
ইগলু। বরফ-গম্বুজ। বলল সে সোৎসাহে, কতদূরের দুই পৃথিবীতে একই সমস্যা-একই সমাধান। আশপাশে পাথর ছাড়া কোনো গৃহায়ণ উপকরণ নেই, আর পাথর দিয়ে কাজ করে বাসা বাঁধা মুখের কথা না। বরফ নিয়ে বানানোর কাজে লো গ্র্যাভিটি নিশ্চই সাহায্য করেছে। কোনো কোনো ডোম তো বেশ বড়। কে জানে কারা বাস করে সেখানে…– ইউরোপা-দুনিয়ার এ প্রান্তে, এই ছোট্ট মহানগরীর অলি-গলিতে কোনো ব্যস্ত তার লক্ষণ নেই। আরো কাছে এসে তারা দেখতে পায় আদৌ পথ-রাজপথের কোনো অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না।
আচ্ছা! এ হল ভেনিস নগরী। বরফ-সৃষ্ট-জল-শহর। বলল ফ্লয়েড তুষ্টির সাথে, একটা ব্যাখ্যা পেয়ে গেলেই মানুষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচে, এখানে রাস্তা বলতে খাল, বাসা বলতে ইগলু।
ঠিক ভেনিস না। ভেনিস আর গ্রিনল্যান্ডের শংকর। প্রাণীগুলো উভচর। মুখ খুলল ভ্যান ডার বার্গ, এমন পরিবেশ আশা করাই উচিত ছিল। গেল কোথায় জীবগুলো?
আমরা ওদের ভয় পাইয়ে দিইনি তো? বিল টির ভিতর থেকে বাইরের দিকটা বেশি শব্দ করে।
মুহূর্তের জন্য ভ্যান ডার বার্গ ভিডিও করা আর রিপোর্ট করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, গ্যালাক্সির সাথে কথা চালাচালির এক পর্যায়ে বলল: এক আধটু যোগাযোগ না করে এ জায়গা ছেড়ে যাই কী করে? আপনাদের কথাই সত্যি হল-এটা মাউন্ট জিউস থেকে অনেক অনেক বড়।
অনেক অনেক ভয়ংকরও হতে পারে কিন্তু।
অগ্রসর প্রযুক্তির কোনো চিহ্নই নেই আশপাশে। কারেকশন-সামনে, সেদিকে একটা বিংশ শতাব্দীর রাডারের মতো কী যেন দেখা যাচ্ছে! আরেকটু কাছে যেতে পারবে, ক্রিসি?
তারপর গুলি খেয়ে মরি? না-বাবা, থ্যাঙ্কস। দূর থেকেই সালাম। তার উপর আমাদের হোভার টাইম ফুরানোর পথে। আর মাত্র মিনিট দশেক। যদি আবার তুমি বাড়ি ফিরতে চাও, তাহলে। না চাইলে আরো অনেক্ষণ ভেসে থাকা যাবে।
অন্তত একবার ল্যান্ড করে আশপাশটায় চোখ বুলাতে পারব তো? সামনে নাঙা পাথরের একটা টিবি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোন্ চুলায় লুকালো সবাই!
ভয়ে ঠ্যাঙ কাঁপছে নিশ্চই, আমার মতো। নীরস ফ্লয়েড একমনে বলে যাচ্ছে, ইউরোপান হবু-সভ্যদের আস্তানা দেখেও তার মনে যেন বিন্দুমাত্র আন্দোলন জাগেনি, নতুন কোনো আবিষ্কারের নেশা কী করে একজন স্পেস অফিসার পাবে? সে থাকবে গাণিতিক হিসাব নিয়ে। ন মিনিট বাকী। বসতির একপাশ থেকে আরেকপাশে একবার উড়ে যেতে পারি, ব্যস। যতটা পার ক্যামেরাবন্দী করে নাও। হু-গ্যাল্যাক্সি-আমরার ওকে-এখন একটু বিজি, এই আর কী!-একটু পর কল করছি–
এইমাত্র বুঝলাম, সেটা মোটেও রাডার ডিশ নয়। একই ধারার ইন্টারেস্টিং কিছু একটা হবে নিশ্চই। জিনিসটা সোজা লুসিফারের দিকে তাক করা-সোলার ফার্নেস! এটা সোলার ফার্নেস!
দেখেই অনেক কিছু বোঝা যাচ্ছে, এমন এক জায়গায় তারা বাস করে যেখানে আগুন ধরানো যাবে না। যেখানে সূর্য কখনো নড়ে না। এবং দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে অন্য পথ বের করতে অসুবিধা কই?
আট মিনিট। আফসোস, সবাই ঘরের দুয়ার দিয়েছে। খোল খোল দ্বার, রাখিও না আর বাহিরে আমারে ভাসায়ে…।
কিংবা ফিরে গেছে পানিতে। চারপাশের খোলা জায়গার ঠিক মাঝখানে বড় বিল্ডিংটা দেখেছ? বাজি ধরবে? এটাই টাউন হল।
অন্য সবগুলো থেকে বড়সড় একটা গড়নের দিকে তার আঙুল তাক করা। ডিজাইনটা পুরো ভিন্ন। খাড়া সিলিন্ডারের একটা সংগ্রহ বলা চলে। সভ্য দুনিয়ার অর্গান পাইপের মতো। তার উপর এটা আর সব ইগলুর মতো পুরো সাদা নয়, বরং গায় গায় নানা রঙের ফোঁটা ছড়ানো।
ইউরোপান শিল্প! যেন কেঁদে ফেলবে ভ্যান ডার বার্গ, এটা কোনো ধরনের দেয়াল-অঙ্কন। কাছে। আরো আরো কাছে! অবশ্যই রেকর্ড নিতে হবে!