“এক ডিগ্রিই লুসিফারকে হারিয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট। আর অন্যদিকে ইউরোপাকেও পাওয়া যাবে। কিন্তু লুসিফারের ক্ষমতার এক শতাংশও পাব না তখন। তারপরও একটা চেষ্টা করে দেখা যাবে। আপনি এক কাজ করুন, ফ্রিকোয়েন্সিগুলোর বর্ণালী, তরঙ্গ খাম, মেরুকরণ সহ আর যা যা করা গেলে কাজ হবে এমন তথ্যগুলো পাঠিয়ে দিন। দু-এক ডিগ্রির জন্য কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। সবচে বড় কথা, এ ব্যাপার নিয়ে আমাদের কেউ এত বেশি মাথা ঘামাবে না যে ডিশটা সরালে তেমন সমস্যা হতে পারে। ভাল কথা, আপনি ইউরোপায় বরফ আর পানি ছাড়া আর কিছু নিশ্চই আশা করেন না?
যদি জানতামই আনন্দিত কণ্ঠ ভ্যান ডার বার্গের, তাহলে সাহায্যের কথা বলতাম না, বলতাম কি?
আর আমিও পাবলিকের সামনে বাহাদুরি ফলাব না। তার উপর আমার নামটাই যাচ্ছেতাই, শেষ অক্ষর দিয়ে শুরু। আপনি আমার চেয়ে একটা মাত্র অক্ষরের জন্য এগিয়ে থাকবেন।
এক বছর আগের কথা: লঙ রেঞ্জ স্ক্যানগুলো তেমন কাজের ছিল না। তারপর ইউরোপার উপর বিম তাক করতে গিয়ে আশাতীত কষ্ট হল সবার। কিন্তু সবুরের মেওয়া ফলবেই, কম্পিউটারে সুন্দর তথ্য এলো অযুত-নিযুত। ফলে ভ্যান ডার বার্গ মানবজাতির প্রথম সদস্য হিসেবে লুসিফার-পরবর্তী ইউরোপার অভ্যন্তরীণ গঠন দেখতে পেয়েছিল সেদিন।
আসলেই, ড. উইলকিন্সের কথামতো প্রায় পুরোটাই বরফ আর পানিতে ভর্তি। ব্যাসল্টের সাথে সাথে কোথাও কোথাও দেখা গেল সালফারের তূপ। কিন্তু দুটো ব্যাপার বেশ গণ্ডগোল পাকায়।
একটা যেন একেবারে নিখুঁত কৃত্রিম বস্তু। দু-কিলোমিটার টাক লম্বা। কোনো রেডিও প্রতিফলনই হচ্ছে না সেটা থেকে। ভ্যান ডার বার্গ ড. উইলকিন্সকে এ নিয়ে ধাঁধায় পড়ে যেতে দিল। তার নিজের ধাঁধা শুধু মাউন্ট জিউস।
ব্যাপারটা বুঝে উঠতে অনেক অনেকদিন লেগে গেল তার। কারণও আছে, এমন কথা আগেভাগে কল্পনা করতে পারে শুধু দুজন-হয় এক পাগল, নাহয় কোনো অতি অগ্রসর কল্পনার বিজ্ঞানী। এমনকি এখনো-সবকিছু কঠিনভাবে চুলচেরা হিসাব করার পরও তার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। পরবর্তীকালে কী যে করবে বা করা উচিৎ তাও ভাবছে না এক বিন্দু।
ড. উইলকিন্স কল করে দু-একটা এদিক-সেদিক করা কথা বলল, খুব বেশি অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়… কোয়ার্টজের কোনো দুর্নল গোত্ৰটোত্র হবে আর কী। পৃথিবীর স্যাম্পলের সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছি এখনো…
এই প্রথমবারের মতো সে কোনো সহকর্মী বিজ্ঞানীর কাছে কাজের ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলল।
কিন্তু এ ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল তার?
১২. ওম পল
রালফ ভ্যান ডার বার্গ প্রায় একযুগ ধরে তার চাচাকে দেখে না। চর্ম-মাংসের শরীরে তাদের আবার দেখা হবার কথাও নয়। এখনো সে এই বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে খুব কাছ থেকে অনুভব করে। এই একজনই তাদের উপজাতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছেন এখন, তাদের সেই পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষদর্শী।
ওম পল নামেই ড. পল ক্রুগারকে ডাকে তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধব। প্রয়োজনের সময় প্রতিবারই তাকে কাছে পেয়েছে ভ্যান ডার বার্গ, সরাসরি অথবা আধ বিলিয়ন কিলোমিটার লম্বা রেডিও সংযোগের মাধ্যমে। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে তার পার্টিকেল ফিজিক্স বিষয়ক আবিষ্কারটি ঘরদোর পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে আরো নানা কাজে ব্যবহৃত হওয়ায় সভ্য দুনিয়ার ধুলো-ময়লা থেকে পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে নতুন যুগের সূচনা হয়। বাজারে জোর গুজব প্রচলিত যে তার প্রাপ্য নোবেল পুরস্কারটি প্রচণ্ড রাজনৈতিক চাপসৃষ্টির কারণেই ঠেকে আছে।
কথাটা সত্যি হলেও ড. পল ক্রুগারের কিস্যু যায় আসে না। একেবারে সাদাসিধে লোক, কারো সাতে-পাঁচে নেই, ব্যক্তিগত একজন শত্রুও মনে হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবী এম্নিতেই তাকে শ্রদ্ধা-সম্মানের ডালি সাজিয়ে দিয়েছে। বেশ কয়েকবার তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ পেয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছেন নিমন্ত্রণ। ইউ এস এস এ বা ইউনাইটেড স্টেটস অব সাউদার্ন আফ্রিকা ভ্রমণ করলে যে তার শারিরীক কোনো ক্ষতি হতে পারে বা আক্রমণ আসতে পারে সে সম্ভাবনা বিন্দুমাত্র নেই কিন্তু তিনি অতীতকে আর সামনে আনতে চান না; চান না অসহ্য নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হতে।
ভ্যান ডার বার্গ যে ভাষা ব্যবহার করেছে সেটা সর্বমোট দশ লাখ লোকও বোঝে কিনা সন্দেহ। নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য যে কোনো মানুষের কাছে এর কোনো অর্থই নেই। ড, পল খবরটিকে তেমন গুরুত্বের সাথে নিতে পারলেন না, যদিও ভাস্তের মেসেজ বুঝতে তার বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি। তার ধারণা রালফ ছোঁড়াটা কোনো গাঁজায় পড়েছে অথবা তাকে দিয়ে কিছু করিয়ে নিতে চাচ্ছে, একটু কাছে টানার চেষ্টাও হতে পারে। ঠিক যেমন তিনি সহজে সাধারণ মানুষের কাছে যান না, অন্তত তাঁর চুপ করে থাকার ক্ষমতাটা ভালই ছিল…
তবু ধরা যাক-শুধু ধরাই যাক না-যদি কথাটা সত্যি হয়েই থাকে, তাহলে? মলিন চুলগুলো পলের ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে গেল সরসর করে। সম্ভাবনার এক নূতন দুয়ার; বৈজ্ঞানিক, আর্থিক, রাজনৈতিক… হঠাৎ করেই তার চোখের সামনে খুলে গেল। তিনি ব্যাপারগুলোকে যতই গোনায় ধরলেন ততই তারা ফুলে-ফেঁপে উঠল।