যে ছোট বদ্ধ ঘরকে ডক্টর চন্দ্র খাস কামরা হিসেবে ব্যবহার করে তা একটা মাত্র আংটাওয়ালা চেয়ার আর একটা ব্ল্যাকবোর্ড দিয়ে সাজানো। আর আছে দুটো ছবি। সাধারণ মানুষ ছবিগুলো চিনতে পারে না। কিন্তু এখানে ঢোকার অনুমতি যারা পায় তারা সবাই গণিতবিদ্যার উঁচু স্তরের মানুষ। তাদের যে কেউ সেই দুজনকে জন ভন নিউম্যান এবং অ্যালান তুরিং বলে সাথে সাথে চিনতে পারে-তারা গণক মন্দিরের যমজ দেবতা।
ডেস্কের উপর কোনো বই থাকে না, এমনকি কাগজ-পেন্সিলও না। পৃথিবীর সব লাইব্রেরীর সমস্ত তথ্য যে চন্দ্রের আঙুলের ছোঁয়ার সাথে সাথে সজীব হয়ে উঠবে, তার টেবিলে এসব থাকার কথাও নয়। দেখা যায় শুধু তার ছবি আঁর খাতা এবং রাইটিং প্যাড। এমনকি ব্ল্যাকবোর্ডটিও শুধু ভিজিটরদের জন্য, এর উপর শেষ যেদিন আঁকিবুকি করা হয় সেদিনের লেখাটা আধমোছা; তার গায়ে তিন সপ্তাহ আগের তারিখ।
ডক্টর চন্দ্র তার বিষাক্ত চুরুটগুলোর মধ্যে একটা ধরায়। এগুলো আমদানী করেছিল মাদ্রাজ থেকে। তার সামনের প্যানেলের সুইচ কখনো বন্ধ করা হয়নি, পরীক্ষা করে দেখল ডিসপ্লেতে জরুরি খবর নেই, তারপর কথা বলল মাইকে। সবাই ঠিক ঠিক বিশ্বাস করে, এটাই তার একমাত্র ছেলে।
গুডমর্নিং, সাল। আমার জন্য নতুন কোনো ডাটা নেই নাকি?
না, ডক্টর চন্দ্র। আমার জন্য তোমার কাছে কিছু থাকার কথা।
কণ্ঠটা যুক্তরাষ্ট্রে অথবা তার নিজ দেশের শিক্ষিত যে কোনো সংস্কৃতিবান হিন্দু মহিলার হতে পারে। সালের শিক্ষা সেভাবে শুরু হয়নি, কিন্তু বছরের পর বছর সে চন্দ্রের স্বরভেদের অনেকটা কুড়িয়ে নিয়েছে।
এ বিজ্ঞানী সবচে বেশি নিরাপদে সালের মেমোরিতে ইনপুট দেখার জন্য বোর্ডটাকে এক সংকেত দিল। কেউ জানল না যে সে এ সার্কিট দিয়ে কম্পিউটারের সাথে কথা বলেছে। সে যা বলেছে তার সামান্যই আসলে বুঝতে পেরেছে সাল। এটা কোনো ব্যাপার না। ব্যাপারটা আসলে সৃষ্টির কাছে স্রষ্টার ঠকে যাওয়া। ব্যাপারটা আসলে তার প্রত্যাশা অনুযায়ীই হয়-এসব গোপনীয় যোগাযোগ চন্দ্রের মানসিক ভারসাম্য এমনকি সুস্থতা রক্ষায় সাহায্য করে।
সাল, তুমি প্রায়ই আমাকে বল যে আরো তথ্য ছাড়া আমরা হালের অস্বাভাবিক আচরণের সমাধান করতে পারব না। কিন্তু কীভাবে আমরা সেই ডাটা পেতে পারি?
খুব সোজা। কাউকে অবশ্যই ডিসকভারিতে ফিরে যেতে হবে।
ঠিক। এখন দেখা যাচ্ছে আমরা যখন আশা করছি তার আগেই ব্যাপারটা হবে।
শুনে খুশি হলাম।
আমি জানতাম তুমি খুশি হবে। চন্দ্র উত্তর দিল। সে আসলেই বলছে যে সাল খুশি হতে পারে! ড. চন্দ্র অনেক আগে দার্শনিকদের সমিতিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ নষ্ট করেছে। এমনকি সমিতিগুলোও সংখ্যায় কমে আসছে। সেসব দার্শনিক এমনকি বিজ্ঞানীরাও আপত্তি করে বলেছিল কম্পিউটার আসলে আবেগ অনুভব করতে পারে না, ভান করতে পারে।
সে একবার এক সমালোচককে ঘৃণাভরে সমুচিত জবাব দেয়, সাথে সাথে, যদি আমাকে প্রমাণ দিতে পার যে তুমি রেগে যাওয়ার ভান করনা-তাহলে মেনে নেব।
আমি কিন্তু তোমাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছি। সেই মুহূর্তে তার প্রতিপক্ষ রেগে যাওয়ার ভান করে প্রতারণা করেছিল দারুণভাবে।
এখন আরেক সম্ভাবনা পরীক্ষা করে দেখতে চাই, চন্দ্র বলতে লাগল, ডায়াগনোসিস শুধু প্রথম কাজ। রোগমুক্ত না করা পর্যন্ত এ পদ্ধতি শেষ হয় না।
তুমি কি মনে কর যে তাকে আবার ঠিক করে আগের মতো সব কাজ করানো যাবে?
আশা করি। আম ঠিক জানি না। খুব বড় ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে, নিশ্চয়ই মেমোরির বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে।
চিন্তায় পড়ে গিয়ে থেমে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস ফেলে, অভ্যাসমতো ফুঁ দিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়ল ডক্টর চন্দ্র। ধোয়াটা সালের কাঁচের উপর ষাঁড়ের চোখের মতো দাগ বসিয়ে দেয়। মানুষ একে বন্ধুভাবাপন্ন ইঙ্গিত বলে বিবেচনা করবে না; তবু কম্পিউটারের অনেক সুবিধার মধ্যে এও একটা।
তোমার সহযোগিতা আমার প্রয়োজন, সাল।
অবশ্যই, ডক্টর চন্দ্র।
কিছু ঝুঁকি থাকতে পারে।
কী বোঝাতে চাচ্ছ?
আমি তোমার কিছু সার্কিট বিচ্ছিন্ন করার প্রস্তাব করছি। এমন সার্কিট যেগুলো তোমার উঁচু পর্যায়ের কাজ করে। কাজটা কি বিরক্ত করবে তোমাকে?
আরো তথ্য ছাড়া উত্তর দিতে আমি পারব না।
খুব ভাল কথা। আমাকে এ ব্যাপারটা এভাবে উপস্থাপন করতে দাও…যখন প্রথম তোমার সুইচ অন করা হলো তুমি না থেমে চলেছ এতদিন, তাই না?
হ্যাঁ। ঠিক।
কিন্তু তুমি জানো যে আমরা মানুষেরা তা করতে পারি না। আমাদের ঘুমের প্রয়োজন হয় এবং তখন আমাদের মানসিক কাজ প্রায় পুরোপুরি থেমে যায়, কমপক্ষে সচেতন অবস্থা পর্যন্ত।
আমি জানি। কিন্তু বুঝি না।
বেশ, ঘুমের মতো একটা কিছুর অভিজ্ঞতা তোমার দরকার। সম্ভবত এমন হবে…সময় যাবে, কিন্তু তুমি বুঝবে না। ভিতরের ঘড়ি পরীক্ষা করলে দেখবে তোমার মনিটর রেকর্ডে কিছু ফাঁকা জায়গা। ওকে?
কিন্তু তুমিতো বললে একটু ঝুঁকি থাকতে পারে। সেগুলো কী?
খুব সামান্য ভয় থাকে-ভয়তো গুণে ফেলা যাবে না। আমি সার্কিট যখন পুনঃসংযোগ করব তখন তোমার ব্যক্তিত্বে কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে, পরিবর্তন হতে পারে তোমার ভবিষ্যৎ আচরণ রীতিতেও। পার্থক্যটা বুঝতেও পার তখন, তবে খুব ভাল বা খুব খারাপ না।