কেউ কোনো আপত্তি করতে পারেনি। মুহূর্তের মধ্যে ইউনিট বদলে দেয়া সহজ। এমনকি নষ্ট হয়ে গেলেও ঠিক করা যায়। শিপে আরো দুটো বাড়তি অংশ আছে।
নষ্ট ইউনিট আনার জন্য বাইরে গিয়েছিল ফ্র্যাঙ্ক পোল, স্পেস পোড়ে চড়ে। স্পেস পোড বিভিন্ন কাজের খুচরো যান; ভ্রাম্যমাণ কারখানা হিসেবেও কাজে লাগত। পোডের হাত বেশ ভাল হলেও অ্যান্টেনা ইউনিট সরানোর কাজ একটু কঠিন। তাই পোড থেকে নেমে যায় পোল, শিপগাত্রের একটা ফুটো ঠিক করে, তারপর তুলে আনে ই ভি এর ইউনিটটা।
কিন্তু পরীক্ষা করে যন্ত্রটা এত ভাল পাওয়া গেল যে সবাই অবাক হয়ে পড়ে। অটোমেটিক চেকিং সেই সার্কিটের কোনো ভুল ধরতে পারেনি। খবরটা আরবানায় পাঠানোর পর হালের যমজ সাল ৯০০০ পৃথিবীতে ফিরে যায়নি আর।
কিন্তু হাল মানুষের চেকিংয়ের ভুলের ব্যাপারে মন্তব্য দেখিয়ে শক্তভাবে বলে চলে, তার কথাই ঠিক।
মিশন কন্ট্রোলের কাছে রিপোর্ট করেছিল বোম্যান। মিশন কন্ট্রোল জানায়, হালকে নিষ্ক্রিয় করে কিছু প্রোগ্রাম অ্যানালাইসিস চালাতে হবে। এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে, হালের ডায়াগোলাইসিস বিষয়ক তথ্য আসার সময় আবার সে ঘোষণা করে যে তার ভুল ধরার অংশ বলছে যে প্রতিস্থাপিত দ্বিতীয় ইউনিটটাও নষ্ট হবার পথে।
সুখী এক শিপের নাম ছিল ডিসকভারি। আনন্দ উবে যায় বোম্যান আর পোলের মন থেকে। তারা ঠিকই বুঝেছে কোনো না কোনো গণ্ডগোল দানা বাঁধবে সেখানে। কয়েক মাস ধরে হালকে ছোট্ট পৃথিবীর তৃতীয় সদস্য হিসেবে নিয়েছিল, এবং জানত তার প্রতিটি মেজাজ সম্পর্কে। সূক্ষ্মভাবে বদলে গেল শিপের অবহাওয়া; বাতাসে টান টান অবস্থা।
মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল বোম্যান। মারাত্মক কিছু হওয়ার ভয় থাকলে হাল সেসব সমস্যার সমাধান করত। ক্রুরা ঠিক করে হালই এখন সমস্যা; ঠিক করে কিন্তু প্রকাশ্য ভাষায় নয়, এম্নিতেই একজন আরেকজনকে বুঝতে পারে। তারপর সন্দেহ সত্ত্বেও তারা যার যার কাজ করে যায়।
পোল দ্বিতীয়বার বেরিয়ে পড়ে।
তারপরের ঘটনা বাইরের ক্যামেরা রেকর্ড করতে পারেনি, একটু সন্দেহজনক ব্যাপার। বোম্যান প্রথমে পোলের চিৎকার শুনতে পায়-তারপর, নিরবতা। এক মুহূর্ত পরে দেখতে পায় পোলকে, হুড়মুড় করে উপরে, আরও উপরে উঠছে, পাক খাচ্ছে মহাশূন্যে। তার নিজের পোডই ধাক্কা দিয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে হয় বিস্ফোরিত।
বোম্যান পরপর বেশ কয়েকটা বড় ভুল করেছে-একটা ছাড়া সবগুলো ক্ষমা করা যায়। হালের প্রতি তার সন্দেহ প্রকাশ করেনি, কিন্তু আচরণে প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
সে মিশন কন্ট্রোলের নিয়ম জানে। কেউ মারা গেলে তার বদলে শীতনিদ্রা তথা হাইবারনেশনে থাকা অন্যদের মধ্যে একজনকে জাগাতে হবে। বোম্যান সন্দেহ করে হাল এলোমেলো কিছু একটা করছে। পর পর দুবার ই ভি এ ইউনিট নষ্ট হয়ে যোগাযোগ বন্ধ হতে পারে না। পোলের মৃত্যুও অস্বাভাবিক। তাই সে অর্ডার করে, সবগুলো হাইবারনেশন ক্যাপসুলের নিয়ন্ত্রণ হালের হাত থেকে সরিয়ে আলাদা স্বাধীন ইউনিটে পরিণত করতে হবে। ক্যাপসুলগুলো কেন্দ্রীয় কম্পিউটারের আওতায় থাকতে পারে আবার স্বয়ং সম্পূর্ণ ইউনিট হিসেবেও থাকতে পারে।
তারপর হাজারো অজুহাত তোলে হাল। সে মানতে রাজি নয়। কাউকে জাগাতেই দিবে না। হাল আর বোম্যানই নাকি যথেষ্ট। বোম্যান এবার কাটা কাটা কথায় আদেশ করে। সাথে সাথে ঘুমন্ত তিন হাইবারনেটরকে হত্যা করে ডিসকভারির সমস্ত বাতাস বাইরে বের করে দিতে শুরু করে হাল। বন্ধ করে দেয় ইলেক্ট্রিসিটি। বোম্যান কোনোমতে একটা ইমার্জেন্সি অক্সিজেন শেল্টারে আশ্রয় নিয়ে, গায়ে স্পেসস্যুট চাপিয়ে, অক্সিজেন সিলিন্ডার কাঁধে ঝুলিয়ে ইমার্জেন্সি লাইটের আলোয় এগিয়ে যায় হালের মস্তিষ্ক ভল্টের সামনে।
শেষে হালকে অসাড় করার জন্য এগিয়ে গিয়ে মাথার মডিউল এর প্লাগ একটা একটা করে খুলে ফেলেছিল ডেভিড বোম্যান; ২০০১ সালে।
জাহাজের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়ে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বোম্যান ছিল একা। পুরো মানব ইতিহাসে এর আগে কেউ এত একা থাকেনি।
এ অবস্থায় অন্যরা হয়ত হতাশায় অসহায়ত্বের কাছে নিজেদের ছেড়ে দিত। কিন্তু এখন ডেভিড বোম্যান প্রমাণ করল যারা তাকে বাছাই করেছিল আসলেই তাদের পছন্দ ভাল। সে ডিসকভারিকে সচল রাখার ব্যবস্থা করে পুরো তরীকে এমন সুন্দরভাবে বসালো যাতে আটকে পড়া অ্যান্টেনা পৃথিবীর দিকে ফেরানো থাকে। এভাবে মিশন কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ আবার শুরু।
ডিসকভারি তার ঈষৎ বাঁকা পথে পৌঁছে যায় লক্ষ্যের দিকে। সেখানে বোম্যান দৈত্য গ্রহের চাঁদ-তারার মেলায় কক্ষপথে ঘোরার সময় টাইকো মনোলিথের মতো ঠিক একই আকৃতির কিন্তু অনেকগুণ বড় কালো এক পাথর খণ্ডের সন্ধান পায়। এটা দেখার জন্যই আসলে মিশন পাঠানো হয়েছিল। বিপদের মুখোমুখি ভালমতো দেখার জন্য সে এক স্পেস পোর্ডে করে বাইরে যায়, এবং সেখানে গিয়েই বলে সেই যুগান্ত কারী কথা, মাই গড! আমার সামনেটা তারায় তারায় ভরা!
তারপর থেকেই ঐ রহস্য আর সবার উদ্বেগের কারণ। ড. চন্দ্র সব সময় হালের সবকিছুতে মুগ্ধ। তার আবেগহীন মনে ঘৃণা ছিল একটা ব্যাপারে। অনিশ্চয়তা। হালের আচরণের কারণ না জানা পর্যন্ত সে কখনো সন্তুষ্ট হবে না। এমনকি এখনো একে ব্যর্থতা বলে সে স্বীকার করে না; বড়দের এ এক অস্বাভাবিক ব্যাপার।