পরিত্যক্ত শিপটার দিকে যাওয়ার আর কোনো নিরাপদ উপায় নেই। ডিসকভারি যে অক্ষ ধরে ঘোরে সেটার কাছাকাছি পৌঁছতে হবে। ডিসকভারির ঘূর্ণন কেন্দ্র প্রায় শিপটার মাঝামাঝি, মূল অ্যান্টেনা কমপ্লেক্সে। ব্রেইলোভস্কি এ পথ ধরেই যাচ্ছে সরাসরি-তার কাঁধে ভীত অংশীদার। কার্নো নিজেকেই প্রশ্ন করে, দুজনকেই কীভাবে থামাব একসাথে?
এখন তাদের সামনের আকাশে বোকার মতো ঘুরছে ডিসকভারি, দেখতে অনেকটা যেন ডাম্বেল। যদিও এটার এক একটা ঘূর্ণন শেষ করতে কয়েক মিনিট সময় নেয়, তবু প্রান্তের দিক বেশ জোরেই ঘুরন্ত। ওয়াল্টার কার্নো সেগুলো উপেক্ষা করে সামনের অনড় জায়গাটুকুর দিকে তাকালো।
আমি সামনের ঐদিকটা টার্গেট করে যাচ্ছি। বলল ব্রেইলোভস্কি, সাহায্যের চেষ্টা করো না আর সামনে যাই হোক অবাক হওয়ার দরকার নেই।
আচ্ছা, ও যাই হোক দিয়ে কী বোঝাতে চায়? নিজেকেই জিজ্ঞেস করল কার্নো। এর মধ্যেই অবাক না হওয়ার জন্য মনকে প্রস্তুত করে নিয়েছে খানিকটা।
পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই সব ঘটে গেল। ব্রেইলোভস্কি ক্ৰমস্টিক ট্রিগার টিপে দিয়ে চার মিটার দূরে শিপের সাথে যোগাযোগ করে একদিকে, অন্যদিকে ক্ৰমস্টিক ভেঙে যাওয়া শুরু করে। শক এবজর্ভিং অংশ ব্রেইলোভস্কির সাধারণ ভরবেগ সামলে নেবে সহজেই। কিন্তু কার্নো আশা করেছিল তাকেও অ্যান্টেনা মাউন্টের দিকে নিয়ে যাবে; এখানেই সমস্যা। জিনিসটা আবারো দ্রুত প্রসারিত হয়ে রাশিয়ানের ভরবেগ সামলে নিল, কিন্তু দুজন থাকায় ম্যাক্স ঠিকই ডিসকভারির গায়ে ধাক্কা খেয়ে একই গতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। কার্নোর পাশ দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে আবার মহাশূণ্যে পড়ে ছিটকে। ভয় পাওয়া আমেরিকানের হাতে শুধু একটা চিকণ হাসি দেয়ার সময় ছিল যখন ম্যাক্স তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। বেচারা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সব সময়।
ধরে রাখা লাইনে দ্রুত একটু ঝাঁকি উঠেই বড়সড় ঢেউ আসে। বিপরীত গতি প্রায় শেষ; আপাতত তারা ডিসকভারির সাপেক্ষে অনড়। কার্নো কোনোমতে সামনের হাতলে পৌঁছতে পেরেই দুজনকে টেনে আনল ভিতরের দিকে।
কখনো রাশিয়ান রোলেট খেলার চেষ্টা করেছ? সে প্রশ্ন করে দম ফিরে পেয়েই।
না-এটা আবার কী?
সময় পেলে অবশ্যই শিখিয়ে দেব। খেলাটা এ কাজের মতোই। বিরক্তি আনতে কোনো জুড়ি নেই।
আশা করি ওয়াল্টার তুমি ম্যাক্সকে কোনো ভয়ংকর কাজ করতে বলবে না, ঠিক? ডক্টর ডেস্কো এমনভাবে কথাটা বলল যেন সে সত্যি সত্যি আঘাত পেয়েছে। কার্নো মনে মনে ঠিক করে ফেলে, জবাব না দেয়াই নিরাপদ; প্রায়ই রাশিয়ানরা তার অদ্ভুত রসিকতা বুঝতেই পারে না। তুমিতো আমাকে প্রায় বোকা বানিয়ে ছেড়েছিলে… সে এত আস্তে আস্তে বলল যাতে মেয়েটা শুনতে না পায়।
এর মধ্যেই তারা বাইরে দিয়ে পৌঁছে গেছে ঘুরতে থাকা শিপের কেন্দ্রে সে আর এটার ঘূর্ণনের ব্যাপারে চিন্তা করে না-বিশেষত তার দৃষ্টি ধাতব প্লেটগুলোর উপরে পড়ার পর। সামনের মইটা অনেক বড়, ডিসকভারির মূল গঠন যে লম্বা শরীর-মই চলে গেছে সেটার বাইরে দিয়ে। গোল কমান্ড মডিউল আর এর পেছনের অংশটা মনে হচ্ছে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে; যদিও সে ভালমতোই জানে যে সে দূরত্বটা মাত্র পঞ্চাশ মিটার।
আমিই আগে যাচ্ছি। দুজনের দড়িকে পেঁচিয়ে নিতে নিতে বলল ব্ৰেইলোভস্কি, মনে রেখ, পাহাড়ের নিচু ঢাল ধরে নামার মতো হবে। কোনো চিন্তা নেই, এক হাতেই ধরে রাখতে পারবে নিজেকে। এমনকি একদম নিচেও মাধ্যাকর্ষণ দশভাগের একভাগ। এ কাজটাই হল… যেটাকে তুমি বল একদম সহজ, চিকেনশিট-মুরগির ইয়ে…
মনে হয় তুমি চিকেনফিডের কথা বলছ। যদি তোমার কাছে বিষ্ঠা আর খাবার একও হয়, তবু আমিই আগে যাব। উল্টোদিক উপরে দিয়ে মই বেয়ে নামতে পছন্দ করি না; তা অভিকর্ষ যত কমই হোক না কেন।
এর দরকার ছিল, কার্নো জানে। তার এই প্রায় দ্র ঠাট্টার জোরে সে অনেক ক্ষেত্রেই জিতে যায়। নাহলে হয়ত উপেক্ষা করা হতো। তাছাড়া এ ব্যাপারটা পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে অনেক কমিয়ে দেয়। বাড়ি থেকে শতকোটি কিলোমিটার দূরে; ঢুকছে মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে সবচে বিখ্যাত পরিত্যক্ত দেহের ভিতরে, যেটা দেখেছে তার সব কুকে একে একে শেষ হয়ে যেতে। একে একবার এক সাংবাদিক বলেছিল স্বর্গের দরজা; তবে পাপীরাও এ দরজা ধরে নরকে যেতে পারবে-তুলনাটা মোটেও খারাপ নয়। এসব ছাড়াও পরিবেশকে আরো মজাদার করার ব্যবস্থা আছে, নিচের দুঃস্বপ্নের মতো আধ আকাশ ভরা চাঁদটাকে মন থেকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করলেও বেহায়ার মতো সে বাদ পড়ে না। যতবার কার্নো ডিসকভারির মই-হাতলে হাত দেয়, ততবার সালফারের ধুলোয় ভরে ওঠে গ্লাভস।
অবশ্যই ব্রেইলোভস্কির কথা ঠিক, এ শিপের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘোরার জন্যে যে অভিকর্ষ তৈরি হয় তাকে সহজে মোকাবিলা করা যাবে। এটা ব্যবহার করে উল্টো কার্নোর সুবিধা হচ্ছে, পাওয়া যাচ্ছে দিকনির্দেশ।
তখন হঠাৎ করেই তারা সেই বিরাট গোলকের বাইরের অংশে চলে গেল যেটাকে বলা হয় ডিসকভারির কন্ট্রোল ও লাইফ সাপোর্ট মডিউল। মাত্র কয়েক মিটার দূরেই সেই ঐতিহাসিক ইমার্জেন্সি হ্যাঁচ।
আশা করি ভিতরে যেতে পারব। বলল ব্রেইলোভস্কি, সারাপথ কষ্ট করে এসে হ্যাঁচ লক করা পেলে ব্যাপারটা খুব করুণ হবে, তাই না?