সুযোগ পেলেই ওকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করো। ও মেনইল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার কথা বলে। মাঝে মাঝে ভয় হয় ও যদি… তুমি যদি ওর কাছাকাছি না
যেতে পার তো ছেলেটাকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করো। আমি যতোটা বলি, তারচে অনেক বেশি মিস করি ক্রিসকে।
ও আংকল দিমিত্রিকে বিশ্বাস করবে-যদি তুমি বল যে বাবা আজও ওকে একই রকম ভালবাসে এবং সুযোগ পেলেই যত তাড়াতাড়ি পারে চলে আসবে।
১৭. ডিসকভারিতে
সবচে বেশি সুবিধার সময়েও কোনো পরিত্যক্ত অকেজো স্পেসশিপকে কজা করা চাট্টিখানি কথা না। আসলে কাজটা সোজা-সাপ্টা বিপজ্জনক।
ওয়াল্টার কার্নো জানে, এ-ই পরম সত্য; কিন্তু নিজের ভিতরে ব্যাপারটা আগে এভাবে অনুভব করেনি শতমিটার লম্বা ডিসকভারিকে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরতে দেখে যেভাবে বুঝতে পারছে-তারা অবশ্য এখন নিরাপদ দূরত্বে। কয়েক বছর আগের সংঘর্ষে ডিসকভারির সামনের গোল অংশটার ঘোরা বন্ধ হয়ে যায়, যেটাকে লোকজন করোসেল বলে। এর ফল হল ভয়ংকর। আগে করোসেলকে ঘুরতে হত নিজের অক্ষে, ফলে ডিসকভারির সামনের অংশে অভিকর্ষ থাকত কিছুটা, সে ঘোরাটা পরিবর্তিত হয়ে এখন সারা ডিসকভারিই ঘোরে! কোনো এক ড্রাম বাদকের ছুঁড়ে দেয়া কাঠির মতো শিপটা নিজের অর্বিটে ঘুরছে ধীরে ধীরে।
প্রথম সমস্যা হল সেই ঘোরাটাকে বন্ধ করা। মরার ঘূর্ণন ডিসকভারিকে শুধু নিয়ন্ত্রণের বাইরেই নিয়ে যায়নি, বরং করেছে অগম্য। ম্যাক্স ব্ৰেইলোভস্কির সাথে স্যুট পরে নিয়ে কানোর নিজেকে খুব অযোগ্য মনে হল, এটা তার কাজ না। সে এর মধ্যেই মুখ আঁধার করে ব্যাখ্যা করেছে, আমি একজন স্পেস ইঞ্জিনিয়ার, স্পেস মাংকি নই যে লাফালাফি করে শিপ পার হব।
কিন্তু করতেই হবে কাজটা। আর একমাত্র তারই সে দক্ষতা আছে যা দিয়ে ডিসকভারিকে আইওর গ্রাস থেকে রক্ষা করা যায়। ম্যাক্স বা তার সহকর্মীরা অপরিচিত সার্কিট ডায়াগ্রাম নিয়ে কাজ করে, তারা আরো প্যাঁচ লাগাবে। কাজ করতে গেলে জ্বালানি ঠিক করে সব নির্ধারণ করে একে পথে নিয়ে আসতে এত সময় লাগবে যে ততোক্ষণে ডিসকভারি আইওর মুখেও পড়ে যেতে পারে।
হেলমেট মাথায় নেয়ার সময় ম্যাক্স প্রশ্ন করল, তুমি ভয় পাওনি, ঠিক?
আমার স্যুট নষ্ট করার মতো ভয় পাইনি। এটাকে হিসাবের বাইরে রাখলে… পেয়েছি।
ম্যাক্স মুখ বাঁকিয়ে হাসি দিল, আমার বলা দরকার, এটুকু ভয় এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয়। নাহলে তোমার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠত। এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তোমাকেও একটা দিব। কী যেন নাম দিয়েছ ওগুলোর?
ঝড়র কাঠি। ক্ৰমস্টিক। কারণ ডাইনীরা এগুলোতে চড়েই উড়ে বেড়ায়।
ও, হ্যাঁ–ব্যবহার করেছ কখনো?
চেষ্টা করেছিলাম একবার, কিন্তু আমারটা চলে যায় দূরে। সবার চোখে ব্যাপারটা মজার; শুধু আমার চোখগুলো ছাড়া।
সব পেশার জন্য ঠিক করা থাকে কিছু জিনিস-খালাসীদের হুক, কুমারের চাকতি, মিস্ত্রির খুন্তির মতো যন্ত্র, ভূতত্ত্ববিদের হাতুড়ি… যেসব মানুষ জিরো গ্র্যাভিটিতে নির্মাণকাজ করে তাদের অতি দরকারি এক যন্ত্র এই ক্ৰমস্টিক, এর উন্নয়ন হয়েছে এজন্যই। খুবই সরল যন্ত্র; এক মিটার লম্বা ফাঁপা টিউবের একপ্রান্তে পা-দানি আর অন্যপ্রান্তে টানা যায় এমন এক বাকানো ফাঁদের মতো অংশ। এক বাটনের চাপেই এর দৈর্ঘ্য পাঁচ-ছ গুণ হতে পারে। ভিতরে কম্পন শুষে নেয়ার অংশ আছে, তাই একজন দক্ষ কর্মী এ দিয়ে ভালই কাজ করতে পারবে। পা-দানিটাও প্রয়োজনে হুক হয়ে যেতে পারে। পরে আরো হাজারবার হাজারো পরিবর্তন আর ডিজাইন আনা হয়েছে, কিন্তু এ হল বেসিক ডিজাইন। ব্যবহার দেখতে খুবই সহজ, কাজে ততটা সহজ নয়।
এয়ারলক পাম্পের বাতাসের চাপ সমান করার কাজ শেষ হয়ে এক্সিট লেখা চলে এসেছে; দরজাগুলো খুলে গেলে তারা আস্তে ভেসে বেরিয়ে গেল বাইরের বিশাল শূন্যতায়।
দুশ মিটার দূরে ডিসকভারি ঘুরছে উইন্ডমিলের মতো, আইওর অর্বিটে তাদের পিছন পিছন আসছে এগিয়ে। আইওর দখলে আধখানা আকাশ, পেছনের বৃহস্পতিও দেখা যায় না। এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তাদের নিজেদের বাঁচাতে হবে আইও আর বৃহস্পতির মাঝে বয়ে যাওয়া ফ্লাক্স টিউবের হাত থেকে সেটা করতে হলে দু গ্রহের সংযোগে থাকা চলবে না। এত কিছুর পরেও তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা অত্যন্ত বেশি। আরেক আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য পনের মিনিট সময়ও হাতে নেই।
সময়মতো কানোর স্যুটে সমস্যা দেখা দিল, পৃথিবী ছাড়ার সময় এটা আমার গায়ে ঠিকমতো লেগেছে। সে বলল আফসোসের সুরে, কিন্তু এখন আমার অবস্থা বাদামের খোসার ভিতর বাদামের মতো।
স্বাভাবিক, ওয়াল্টার। রেডিও সার্কিটে নাক গলিয়ে বলল সার্জন কমান্ডার রুডেঙ্কা, হাইবারনেশনে দশ কেজি ওজন কমে, তোমার জন্য ভালই হত কিন্তু এরি মধ্যে ফিরে এসেছে তিন কিলো।
সুন্দর একটা জবাব খুঁজে পাওয়ার আগেই সে নিজের শরীরটাকে শিপের বাইরে ভেসে যেতে দেখল।
রিল্যাক্স কর, ওয়াল্টার। বলল ব্রেইলোভস্কি, ঘুরতে শুরু করলেও জেট গ্লাস্টার অন করো না, দেখা যাক কী করতে পারি।
কার্নো কমবয়েসি ছেলেটার ব্যাকপ্যাক থেকে আসা হালকা ধোয়া দেখতে পাচ্ছে, সেটার ছোট্ট জেট ইঞ্জিনই তাদের নিয়ে যাচ্ছে ডিসকভারির দিকে। প্রত্যেক ছোট ধোয়া-কুণ্ডলীর সাথে সাথেই দুই শিপের মাঝের দড়ি ধরে আরো এগিয়ে যায় ওরা। একটা ইয়ো-ইয়ো যেমন পৃথিবীর বুকে ওঠানামা করে, সেভাবেই ঝুলতে ঝুলতে এগুচ্ছে সামনে।